জাল
ঘুরতে ঘুরতে কীভাবে আমি যে রামলাল ব্রাহ্মণের কাছে গিয়ে পড়েছিলাম, তা আমি এখনো বলতে পারি না। হাজারিবাগের জঙ্গলে ঘুরছিলাম জীবিকা অর্জনের চেষ্টায়। সামান্য অবস্থার গৃহস্থের ছেলে, ম্যাট্রিক পাস দিয়ে অর্থ উপার্জনের ব্যাপারে কত জায়গায় না গিয়েছি। কে যেন বলেছিল, হর্তুকী আমলকী বয়ড়া চালান দিলে অনেক লাভ হয়। তারই সন্ধানে ঘুরছি, রামগড় থেকে দামোদর নদ পার হয়ে—ক্রমোচ্চ মালভূমির অরণ্যসংকুল পথে পথে।
জল খাব। বেজায় তৃষ্ণা। সে পাহাড়ের আর বনের অপূর্ব শোভার মধ্যে, বনজকুসুম-সুবাস ভেসে আসতে পারে বাতাসে, কিন্তু জলের সঙ্গে খোঁজ নেই।
রাঁচির লাল মোটর-সার্ভিসের বাসগুলো মাঝে মাঝে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। এক জায়গায় একটা বড়ো বাড়ি দেখলাম রাস্তা থেকে কিছুদূরে বনের মধ্যে। বিস্মিত যে না-হয়েছিলাম এমন নয়। এই পাণ্ডব-বর্জিত দেশে অন্তত দু-লক্ষ টাকা খরচ করে বাড়ি করলে কে? তার আবার মস্ত-বড়ো তোরণ, সাঁচীস্তুপের তোরণের অনুকরণে। তার ওপরে হিন্দিতে লেখা—’ভরহেচ নগর’।
সে কী ব্যাপার?
নগর কোথায় এখানে? একখানা তো বড়ো বাড়ি ওই অদূরে শোভা পাচ্ছে।
যাক গে, আমার তৃষ্ণার জল এক ঘটি পেলেই মিটে গেল।
ভরহেচ নগরের বিশাল তোরণ অতিক্রম করে প্রশস্ত রাজপথে পদচারণা করতে করতে প্রাসাদের মর্মরখচিত প্রশস্ত অলিন্দে গিয়ে সোজা উঠে পড়ি। এত-বড়ো নগরীতে জনসমাগম তেমন যে খুব বিপুল তা নয়। এ পর্যন্ত পুড়িয়ে খেতে একটি প্রাণীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ হয়নি।
এখন দেখছি, ওই যে একটু বুড়োমতো মানুষ বৈঠকখানায় বসে আছে বটে…
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললাম, থোড়া জল পিনে মাংতা।
বৃদ্ধ লোকটি আমার দিকে চেয়ে দেখেই ব্যস্ত হয়ে উঠল—ও, আপ পানি পিয়েঙ্গে? এই ভগীরথ, ই-ধার আও—আপ আইয়ে বৈঠিয়ে—আপ বাঙালি? আসুন, আসুন—বসেন। আমার বড়বাজারে কারবার ছিল। বাংলা জানি, বসেন।
এইভাবে রামলাল ব্রাহ্মণের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়।
—এই ভগীরথ, ঘোড়া পানি তো আগে পিলাও বাবুজিকো। চা খান?
–আজ্ঞে হ্যাঁ!
–এই ভগীরথ, সাবিত্রীকো বোলো চা বানানেকে লিয়ে। ভালো হয়ে বসুন। আপনার নাম কী আছে?
—আমার নাম হিতেন্দ্রনাথ কুশারী—দেশ বসিরহাট, চব্বিশ পরগনা।
–কুশারী? ব্রাহ্মণ আছে তো? না কী আছে?
–ব্রাহ্মণ, রাঢ়ীশ্রেণি।
—ঠিক আছে, নোমোস্কার। আমিও ব্রাহ্মণ আছি, আমার নাম রামলাল ব্রাহ্মণ, দেশ ভরহেচ নগর, বিকানীর।
–ও, তাই বুঝি…
—ঠিক ধরিয়েছেন। বাঙালি জাত বড়ো বুদ্ধিমান আছে। কথা গিরনেসে মালুম করলেতা হ্যায়। এ জায়গাটা আচ্ছা লাগে। বন আছে চারদিকে। গোলমাল নেই। তুলসীজি বলিয়েছেন, দণ্ডক-বনের শোভা কীরকম আছে?–
শোভিত দণ্ডক বন কী রুচি বনী ডাঁতিন ডাঁতিন সুন্দর ঘনী কুছু বুঝলেন? দণ্ডক-কাননের বড়ো শোভা আছে। বৃচ্ছ, ফল-পাত্তিসে খুব সুন্দর। রামায়ণের কথা আছে। তা এই জায়গাটা তেমনি লাগে আমার। দেড়শো বিঘে লিয়েছি এখানে বহুৎ সুবিস্তাসে। তিশ টাকা বিঘা।
-বলেন কী!
—কেন না হোবে? বাঘ ভালু ছাড়া এখানে বাস করবে কে?
—কার জমি?
—শিরোহির এক মৌজাদারের। ধরতীনারান মুন্সি, পুরুলিয়ায় কারবার-ভি আছে। ওখানেই থাকে।
জল এল। আমি বাইরে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিয়ে জল পান করলাম। শরীর ঠাণ্ডা হল। শুধু জল নিয়ে আসার জন্যে শুনলাম রামলাল ব্রাহ্মণ চাকরকে তাড়না করছে খাঁটি ঠেঁট হিন্দিতে, যার মর্ম হল—তোমার মগজে কোনো বুদ্ধি নেই। চাবুতারায় ভদ্রলোক এল, তুমি শুধু এক লোটা পানি…কেন, এক মুঠো শুখা বুটও কী ছিল না ঘরে? এই রকম আদব শিক্ষা হচ্ছে তোমার দিন দিন? মাইজিকে কিংবা রংধারীমাইকে জিগ্যেস করলে না কেন?
আমি জল খেয়ে ঘরে ঢুকতেই বৃদ্ধ কথা বন্ধ করে দিলে চাকরের সঙ্গে। আমার দিকে চেয়ে বললে—আউর পিয়েঙ্গে? নেহি? ঠিক আছে।…পান?
—পান চলে, তবে থাক সে এখন।
—আচ্ছা, থোড়া মিঠাই তো খা-লিজিয়ে! ও সাবিত্রী—
সাবিত্রী কোনো বড় মেয়ের নাম নয়। আট-নয় বছরের একটি ফুটফুটে মেয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকল একটা থালায় সাত-আটটা বড়ো বড়ো লাড়ু নিয়ে, বুঁদের লাড্ডু।
লাড্ডুগুলোর চেহারা এমন লোভনীয়, গা থেকে ঘি যেন ঝরে পড়ছে— কিশমিশ বাদাম দেখা যাচ্ছে লাড়ুর গায়ে। বৃদ্ধ আমাকে পাঁচ-ছটা লাড়ু খাইয়ে তবে ছাড়লে। ওর ভদ্রতা আমাকে মুগ্ধ করল। আমি বাইরের লোক, সম্পূর্ণ অপরিচিত, জল খেতে চেয়েছিলাম এই মাত্র সম্বন্ধ।
এইবার আমি বিদায় নিতে উদ্যত হলাম, বৃদ্ধ সে-কথায় কানও দিলে না।
—আরে কোথায় যাবেন আপনি? নেহি যাইয়ে-গা আজ। জংলী পথ, শেরকা বড়ো ডর। আজ তো নেহি জানা চাহিয়ে।
—সে কী! আমি যাব না?
—থোড়া নাস্তা কর লেন, দাল-রোটি খান, গপসপ করুন। যাবেন—আমার মোটর আপনাকে পৌঁছিয়ে দেবে হাজারিবাগমে।
মোট কথা এই যে, আমার সেদিন যাওয়া হল না। বিকেলবেলা আমাকে নিয়ে বৃদ্ধ ওদের ভরহেচ নগরের পশ্চিমপ্রান্তে বেড়াতে গেল। কী অপূর্ব শোভা চারিদিকে। কমব্রিটাস লতার সাদা পাতার গুচ্ছ বড়ো বড়ো শালগাছের মাথায় এমনভাবে সাজানো, যেন দূর থেকে মনে হয় ওরা প্রাচীন শালতরুর পুষ্পস্তবক। পাহাড়ের পেছনে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, নিঃশব্দে বনভূমিতে দূরে দূরে রহস্যময় অন্ধকার নেমেছে। বনের মধ্যে ধনেশ পাখি কু-স্বরে ডাকছে, বড়ো সম্বর হরিণের রব শোনা গেল একবার মাত্র। কী নির্জন চারিধার…মুক্তরূপা ধরিত্রীর জ্যোৎস্না, সূর্যাস্ত ও অরুণোদয় এখানে এক-একটি কাব্য। শুধুই সবুজ বনশীৰ্ষ, শুধুই ধূসরবর্ণ পাথরের তৈরি শিখরদেশ, অস্ত-দিগন্তের সিঁদুর-ছোঁয়া…
রামলাল ব্রাহ্মণ বললে, এখানে বহুত জমিন আমি লিয়েছে। কলকাত্তা-মে বড়া ধকল আউর ঘিঞ্জি। এখানে জমিন লিয়ে বাড়ি করিয়েছে, কিন্তু ভালা আদমি নেই। বাঙ্গালিলোক আনেসে হাম জমি মুফৎ-সে দে দেঙ্গে। আপনারা আসবেন?
—তা আমি বলে দেখতে পারি।
—হ্যাঁ, জরুর দেখিয়ে গা। এক পয়সা দাম হাম নেহি লেঙ্গে। তিন-তিন বিঘা দে দেঙ্গে হর-এক ফ্যামিলিকো।
-বেশ। আপনাদের এখানে কতজন লোক থাকে?
—এই দশ-বারোঠো আদমি রহতা হ্যায়। নৌকর চাকর লে-কর-কে। লোক নেই, ওই আমার বড়ো দুঃখু আছে।
—আমি বলে দেখব, আসতে পারে, অনেকে জমি তো পাচ্ছেই না। দশ বিশগুণ দাম দিয়ে জমি কিনেচে।
—একপয়সা নেহি দেনে হোগা। যেতনা জমি মাঙ্গে, ও হাম দে দেঙ্গে। আপনি আসুন না? আপনি এলে পাঁচ বিঘা জমি দেব।
আমি জমি কি করব এখানে? অবস্থা এমন কিছু ভালো নয় যে, জমি কিনে বাড়ি করব! কাকে নিয়েই বা ঘর পাতব? আমি হচ্চি ভবঘুরে ক্লাসের লোক। জমি-বাড়ি আমার জন্যে নয়। কথাটা বলেই ফেল্লাম। বৃদ্ধ বললে—আপনি সাদি করেননি?
–না।
—ঘরমে কৌন হ্যায়?
—কাকা আছেন, তাঁর ছেলেরা আছে।
—মা-বাপ-ভি নেহি?
—কিছু না।
—এখানে কোথায় যাচ্ছেন?
—কোথাও না। ব্যাবসা করব বলে দেখে বেড়াচ্ছি।
রামলাল হেসে বললে—কুছু-কুছু লিখাপড়া তো জানেন?
—তা জানি।
–ব্যাস, তবে মিটেই গেল তো। আপনি আমার এখানে আসুন।…সমজা?
—কী সমজাব? এখানে কী করে থাকব, থাকলে পেট চলবে কোথা থেকে? খাব কী?
বৃদ্ধ হো হো করে হেসে উঠে বললে—খাবার কুছ তকলিফ নেই হোবে, আমি খেতে দেব। আপনাকে আমি রেখে দেব এখানে। মৌজ-মে থাকবেন। খাবেন। আজসে রহ যাইয়ে। বড়ো খুশি হব। দো-মনা মাৎ কিজিয়ে। একঠো ঘর আপকো দে দেঙ্গে বার্সেকে লিয়ে। থাকতেই হবে আপনাকে।
ভবঘুরে আমি সেইদিন থেকে ভরহেচ নগরে স্থায়ী নাগরিক হয়ে পড়লাম।
বৃদ্ধ রামলাল ও আমি কখনো বৈঠকখানায়, কখনো বনের প্রান্তে বসে ভবিষ্যতের ছবি আঁকতাম। ভরহেচ নগর মস্ত জায়গা হবে…এখানে হবে সিমেন্টের কারখানা…ওখানে হবে কাচের কারখানা…এখান দিয়ে রাস্তা বেরুবে…বাসিন্দা ভদ্রলোকদের জমি ওইদিকে হবে…কোনো কোনো জমিতে তরিতরকারির আবাদ হবে ইত্যাদি। সবটাই আকাশকুসুম। কেউ আসবার কোনো আগ্রহ দেখালে না এখানে। দেখাবেও না, তা বেশ বুঝলাম।
ক্রমে আমি এদের পরিবারের সব খবর জানলাম। রামলাল ব্রাহ্মণের তিনটি পুত্র। কলকাতায় ওই বৃদ্ধের বড়ো কারবার ছিল, সে-সব বেচে দিয়ে এই ভরহেচ নগরের পত্তন হয়েছে। ব্যাঙ্কে এখনো অনেক টাকা। ছেলেরা কেউ রাঁচি, কেউ বিকানীরে থাকে। বড়ো ছেলের পুত্র দরিরাম এই ভরহেচ নগরেই বাস করে। সাবিত্রী বলে ছোট্ট খুকি তারই মেয়ে। পুত্রবধূর নাম অনসূয়া, খুব মোটা, মাঝে মাঝে ঝোলা ঘোমটা দিয়ে মোটরে কখনো রাঁচি, কখনো হাজারীবাগ যায়। রামলালের স্ত্রী নেই, অনসূয়া বাই খুব সেবা করে। আরও তিন-চারটি নাতি-নাতনি আছে, তারা ঠাকুরদাদার বড়ো একটা ঘেঁষ নেয় না।
অনসূয়া বাই আমাকেও আড়াল থেকে বেশ আদরযত্ন করে, সেটা আমি বুঝতে পারি। লোক এরা খারাপ নয়। ঘি, পুরি, চাটনি, বড়ো বড়ো লঙ্কার আচার, বাজরার রুটি, হালুয়া কিশমিশ মিশ্রিত দুধ, খুব খেয়ে পনেরো দিনের মধ্যে আয়নায় নিজের মুখ আর নিজে চিনতে পারিনে। একদিন খেতে বসেছি, অনসূয়া বাই আড়াল থেকে বলে পাঠালে, আমি অত কম খাই কেন?
আমি বললাম—সে কী! কত খাব? খুব খাচ্চি।
খবর এল—না। রাত্রে ওই ক-খানা পরোটা খেয়ে মানুষ বাঁচে? আরো বেশি খেতে হবে।
—মাসিমাকে বলল, তাঁর কথার ওপর আমি কথা বলতে পারিনে। তিনি যা বলবেন আমি করব।
—বাঙালিরা খুব মছলি খায়, এখানে মছলি যখন মেলে না, তখন দুধ ঘিউ তার বদলে খুব খেতে হবে।
—যতটা পারি নিশ্চয় খাব।
অনসূয়া বাইয়ের যত্ন আমি ভুলব না। যদিও কখনো আমার সামনে সে বেরোয়নি, তবু আমার সব রকম সুখ-সুবিধা আড়াল থেকে এমন তদারক করতেও আমি কাউকে দেখিনি।
এরা সত্যি একটি অদ্ভুত ভালো পরিবার।
এ ধরনের মানুষের দল যে এই স্বার্থপর পৃথিবীতে এসব দিনেও বর্তমান আছে, তা জানতাম না। আমাকে ওরা জমি দিয়ে বাস করাবে, আমার উন্নতি করে দেবে —রামলাল ব্রাহ্মণ এ-সব আশ্বাস কত দিত আমাকে। রামলালের স্বপ্ন ভেঙে দিতে আমার কষ্ট হত। আমি বেশ দেখতে পেতাম ভরহেচ নগরের পরিণাম। এই বুড়ো যতদিন বেঁচে, ততদিন এই নগরীর আয়ু। তারপরেই এই ভরহেচ নগরের রাজপথে ছোটোনাগপুর অরণ্যের নাম-করা বাঘের দল বায়ু-সেবন করবে। অরণ্য তার পূর্ব অধিকার আবার পত্তন করবে। ওর ছেলেরা বিলাসী যুবক, এই জঙ্গলের মধ্যে এসে বাস করবার জন্যে তাদের রাত্রে ঘুম হচ্ছে না!
কেউ এসে এখানে বাইরে থেকেও বাস করবে না।
কারণ যারা আসবে, তাদের উপজীবিকা হবে কী এ নির্জন অরণ্যে? ভরহেচ নগর তো তাদের খেতে দেবে না। রামলালের মতো ব্যাঙ্কে টাকাও থাকবে না তাদের। এই প্রস্তর-সংকুল মালভূমিতে চাষবাস করবে কীসের? আর যারা সত্যিই রামলালের মতো ধনী, তারা শহরের শত সুখবিলাসের মোহ কাটিয়ে এই পাণ্ডববর্জিত স্থানে আসতে যাবে কেন? ওর ছেলেরাই তো আসে না।
রামলাল মাঝে মাঝে আমার বলে—তোমার কী মনে হচ্চে? লোক কতদিনের মধ্যে এখানে হবে?
—শিগগির হবে।
—এক-একজন গৃহস্থকে কতটা জমি দেওয়া দরকার?
—কতটা মোট জমি আপনার?–দেড়শো বিঘা। দরকার হেনেসে আউর বন্দবস্ত করেঙ্গে।
—ধরুন, পাঁচ বিঘে।
—তিন বিঘা হাম ঠিক কিয়া।
—জলের কী ব্যবস্থা হবে?
—ইন্দারামে ইলেকট্রিক ও পাম্প বসা দেগা, তামাম জায়গামে পানি সাপ্লাই হোগা—কুছ ভি নেহি—ওসব ঠিক হো যায়গা।
—ঠিক আছে।
—তোমায় সব দেখাশোনা করতে হবে।
–নিশ্চয় করব। আনন্দের সঙ্গে করব।
এ ধরনের কথা প্রায়ই হত।
মুখে যাই বলি, বুড়ো রামলালের জন্যে আমার দুঃখ হয়। মনে যা আসে কখনো মুখ ফুটে প্রকাশ করতে পারিনি।
অনসূয়া বাই একদিন খাবার সময় বলে পাঠালে—খোকা-ফলের তরকারি খাবে?
—সে আবার কী?
—বিকানীরে হয়। শুকনো ফল দেশ থেকে এসেছে, ভিজিয়ে রেখে তরকারি হবে। খেয়ে দেখো, খুব ভালো।
—মাসিমা যখন বলছেন, নিশ্চয়ই খাব।
ওদের তরকারির কোনোটাই আমার ভালো লাগে না। অন্য ধরনের রান্না, বাংলা দেশের মতো খেতে নয় কোনোটাই। তবে ঘি আর দুধের প্রাচুর্যে সব মানিয়ে যেত। দিনকতক পরে ভাবলাম, এখানে বসে বসে খাচ্চি কেন, এদের কী উপকার আমি করচি এর বদলে? ওরা আমায় যে কাজের জন্যে রেখেচে, সে কাজ কোনদিনই তো হবে না এদের।
রামলালকে বললাম—আমি কী করব, বলুন?
—কামকাওয়াস্তে ঘাবড়াও মাৎ, কাম মিল জায়গা।
—সাবিত্রীকে কেন পড়াই না?
—কী পড়াবে?
—ইংরেজি, বাংলা।
—হাঁ, ও হোনেসে বহুৎ আচ্ছা। পঢ়াও।
অনসূয়া বাই খুব খুশি। মেয়েকে খুব সাজিয়ে-গুছিয়ে আমার কাছে পাঠিয়ে দিলে। আমি মন দিয়ে তাকে পড়াতে শুরু করি। মুখে মুখে ইতিহাস শেখাই, গ্রহনক্ষত্রের কথা বলি। সাবিত্রী তেমন বুদ্ধিমতী নয়, পড়াশোনার দিকে মন নেই তার। অনিচ্ছার সঙ্গে বসে বসে কথা শুনে যায়, শুধু ঘাড় নাড়ে। ওদের একটি ছেলের একবার অসুখ হয়েছিল, রাঁচি থেকে ডাক্তার নিয়ে এলাম, ওষুধ নিয়ে এলাম। নানারকম চেষ্টা করি ওদের সেবা করতে।
সারাবছর এইভাবে কেটে গেল।
ভরহেচ নগরের জনসংখ্যা আমি এসে সেই যে বাড়িয়েছিলাম, তারপর আর বাড়ল না।
একদিন অপূর্ব জ্যোৎস্নারাত্রে নগরতোরণের পাশে প্রস্তর-বেদিকায় বসে আমি একা একা, এমন সময় দেখি, অনসূয়া বাই প্রশস্ত রাজপথে পদচারণ করতে করতে তোরণের কাছে এসে আমায় দেখে থমকে দাঁড়িয়ে থতমত খেয়ে গেল।
আমি বেদি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করে বললাম—মাসিমা। অনসূয়া হিন্দিতে বললে—এখানে একা বসে যে?
—এই একটু বসে আছি।
—খাওয়া হয়েচে, পেট ভরেছে তো?
—দেখুন তো! আপনি প্রায়ই অমন বলে পাঠান, আমার লজ্জা করে।
—এখানে আছে, তোমার মা নেই কাছে, আমাদের দেখতে হবে না?
–মায়ের জাত আপনারা। ঠিক কাজ আপনাদের।
—সাদি করোনি কেন?
—কী খাওয়াব বলুন? আমি তো আপনাদের দয়ায় খেয়ে বেঁচে আছি।
—বেটা, এ-রকম কথা বোলো না, শুনলে কষ্ট হয়। তুমি কী আমাদের পর? আমাদের ঘরের একজন।
—সে আপনাদের দয়া।
—কিছু না বেটা। তোমাকে সাদি দিয়ে এই ভরহেচ নগরে বাস করাব।
আবার সেই আকাশকুসুম। আবার ভরহেচ নগরের কথা। ওদের মন কী সুন্দর! কত জায়গায় গেলাম, এদের মতো মন কোথাও পেলাম না। অনসূয়া বাই হেসে চলে গেল, আমাকে বলে গেল—ঠাণ্ডায় আর বেশিক্ষণ বসে থেকো না, বোখার এসে যাবে। তা ছাড়া এত রাত্রে ফটকের বাইরে বসে থাকাও নিরাপদ নয়, বাঘ না-আসে, ভালুক আসতে পারে।
আমি পেছন থেকে ডেকে বললাম—শুনুন, ও মাসিমা! বাঘ দেখেচেন এখানে কোনোদিন?
—দু-তিন দিন। বড়কা বাঘ। রাঁচি থেকে আসবার পথে দেখেচি, মোটরের হেডলাইটের সামনে। এই ফটকের বাইরে এই রাস্তার ওপরে সন্ধের পর দেখেচি। তুমি চলে এসো—শোনো আমার কথা।
—যাচ্চি এখুনি।
অনসূয়া চলে গেল, কিন্তু আমি তখনি উঠতে পারলাম না। নির্জন জ্যোৎস্নারাতের শোভার সঙ্গে মিশে গেল হারানো মায়ের কথা। মেয়েরা হচ্চে, আসলে মা, তারপর অন্য কিছু। কী ভালো লাগল সে-রাত্রে অনসূয়া বাইয়ের স্নেহসিক্ত ওই সামান্য দুটি কথা।
তারপর আমি একা কতক্ষণ তোরণের বহির্ভাগে সেই বেদিটায় বসে রইলাম। হু-হু বাতাস বইছে, সপ্তপর্ণ-পুষ্পের উগ্র সুবাস ভেসে আসচে বনের দিক থেকে, হৈমন্তী-জ্যোৎস্নাস্নাত এই বনান্তস্থলী স্বপ্নপুরীর মতো মায়া বিস্তার করেছে এই বৃদ্ধ রামলালের মনে, অনসূয়া বাইয়ের মনে, সাবিত্রীর মনে…
কিন্তু আমার এ বিলাস কেন? ওরা বড়োলোক, ওদের সব সাজে, সব মানাবে। আমি এখানে পড়ে থাকব ওদের মায়ায়, ভরহেচ নগরের নাগরিকের অধিকার নিয়ে—তাতে কী আমার পেট ভরবে?
বাড়িতে আমার আত্মীয়স্বজন আছে, আমায় বিয়ে-থাওয়া করে সংসার করতে হবে…মেয়ের বিয়ে, ছেলের পৈতে, ছেলের লেখাপড়ার ব্যবস্থা, সবই করতে হবে আমাকে। এখানে দুটি বেলা শুধু উদর পূরণের জন্য পড়ে আছি, বেতনের দাবি করব কোন মুখে! কোনো কাজই এখানে করি না, কেবল সাবিত্রীকে একটু-আধটু পড়ানো ছাড়া। তার বদলে তো এরা রাজভোগ দু-বেলা জোগাচ্চে।
যেতাম হয়তো একদিন।
কিন্তু বড়ো জড়িয়ে পড়েচি এদের সকলের মায়ায়। বৃদ্ধ রামলাল ব্রাহ্মণকে আমার বুড়ো বাবার মতো মনে হয়। সেইরকম খামখেয়ালি, সেইরকম স্নেহশীল। সাবিত্রীকে ছোটো বোনের মতো লাগে। অনুসূয়া বাই নিতান্ত সরলা মহিলা, তেমনি স্নেহময়ী। মা মারা যাওয়ার পরে এমন স্নেহত্ন আমি নিজের মামারবাড়ি পাইনি, কাকার বাড়ি পাইনি, কোনো আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি পাইনি। অনাত্মীয় জগতের নির্মমতার মধ্যে যেতে ইচ্ছে হয় না, আর শুধু সেইজন্যেই যাই-যাই করেও এতদিন যাওয়া হয়নি।
অনেক রাত্রে এসে শুয়ে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে গাঢ় নিদ্রা। এইভাবেই দিন কাটে। আলস্য এসে জোটে, কোনো সংকল্পই দানা বাঁধে না—কাজে পরিণত করা তো দূরের কথা।
রামলাল আমায় বললে—আরে তোমায় একখানা ডেরা করিয়ে দেব? দুজনে সকালে বৈঠকখানায় বসে কথা হচ্ছিল।
-কেন?
—নিজের ঘর না-হোলে মন টেকে না।
—আপনাদের ঘর কী আমার ঘর না?
—ও তো একটা কথার কথা হোলো।
—মোটেই কথার কথা নয়, আমি তাই ভাবি।
—সে তো বহুৎ আচ্ছা। তাহোলে একঠো সাদি করিয়ে আনে।
–বাবারে! নিজের চলে না, আবার সাদি।
—তুমি করিয়ে নিয়ে এসো, আমি যতদিন আছি, সব-কিছু করিয়ে দেব। সে ভাবনা আমার।
—আমাকে এখানে বরাবর রাখতে চান?
বৃদ্ধ রামলাল বিস্ময়ের সুরে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে—নেই রহিয়ে গা তো যায়গা কাঁহা? ইসকো মানে ক্যা হায়? তুমি তো আছই এখানে।
-কেন, নিজের দেশে যাব?
—কাহে যায়গা? জমি আমি করিয়ে দেব, ঘর-ভি তৈয়ার করিয়ে দেব। সাদি উদি করিয়ে, বহুঁকো হাপর লেকে আওগে।
—সে বেশ মজার কথা।
—যো কুছ বাত বলব, তো মজাকা কথা ছোড় কর দুসরা তরহ বাত মুখ থিকে বাহার নেই হোবে! কেৎনা রোজ তুম হিয়াপর হ্যায়?
—দু-বছর হবে সামনের ফাল্গুন মাসে।
–ব্যাস, তব তো হইয়ে গেল। তুমি আমাদের আদমি বন গেল। দু-বছর যখন এখানে থাকা করিয়েসে, তখন তোমাকে এখানে ঘর বনানে পড়েগা, সাদি-ভি করনে পড়েগা।
কথা শেষ করেই বৃদ্ধ রামলাল খিলখিল শব্দে হেসেই খুন! এও একটি আস্ত পাগল। বাইরের জগতের কোনো সন্ধান রাখে না, নিজের মধ্যেই আত্মসম্পূর্ণ হয়ে বেশ একটি মায়ার নীড় রচনা করে ঊর্ণনাভের মতো তার কেন্দ্রে বসে আছে। কী চমৎকার, কী সুন্দর জালটি বুনেচে। নাঃ, বড়ো ভালো এরা।
সে ফাগুন মাসও কেটে গেল। সেই জনহীন মালভূমির বনে বনে পলাশের ফুল আগুনের বন্যা নিয়ে এল, মহুয়া ফুল নিয়ে এল মাতাল-মধুর বন্যা। কুরচি আর করন্ধা নিয়ে এল সুগন্ধের বন্যা। অথচ কেউ দেখল না সেই অপরূপ ঋতু-উৎসব, কোনো দিকে তার খবর গেল না—খানিকটা দেখলে বুড়ো রামলাল, আওড়ায় রামচরিতমানস থেকে
শোভিত দণ্ডক কি রুচি বনী—
আর অবিশ্যি খানিকটা দেখলুম আমি।
কিন্তু সেই বসন্তে যেমন প্রাণ চঞ্চল হল, মনও উতলা হল আমার। চলে যেতে হবে এখান থেকে আমাকে। আমি বুড়ো রামলাল নই, অনসূয়া বাইয়ের মতো বড়োলোকের বউ নই—আমার ভবিষ্যৎ আছে, এখানে যতই ভালো লাগুক, আমার ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে এখানে থাকলে।
অনসূয়া বাই আমাকে বলে পাঠালে, তার সঙ্গে মোটরে রাঁচিতে যেতে হবে। এর আগেও দু-একবার হাজারিবাগে গিয়েচি! যে-বার সঙ্গে টাকাকড়ি বেশি থাকে, সে-বার আমাকে নেয়।
এবার ঠিক করলাম, রাঁচি গিয়ে পালাব।
তারপর কী কাণ্ডটাই হল। রাঁচি বড়ো পোস্ট অফিসের সামনে আমি গা-ঢাকা দিলাম। অনসূয়া বাই তার দেওরের গদিতে গিয়েচে কী কাজে—মোটর ওখানেই ছিল। ফিরে এসে দেখলে, আমাকে ওর চাকর ও ড্রাইভার খোঁজাখুঁজি করচে। ও ধরে নিলে, আমি গেঁয়োলোক শহরে এসে হারিয়ে গিয়েচি। গদিতে গিয়ে জানিয়ে তোলপাড় করলে—টাকাপয়সা পুলিশ ও লোকজনের সাহায্যে রাঁচি শহর—মা যেমন হারানো সন্তানকে খোঁজে, তেমনি করে অনসূয়া বাই খুঁজলে তাদের অর্থবল ও লোকবল দিয়ে আমাকে। খুঁজে বার করলে রাঁচি-চক্রধরপুর-সার্ভিসের বাস থেকে। এর কৈফিয়ত দিতে হল নানা রকমে বানিয়ে। ঘটনার দু-তিন সপ্তাহ পর পর্যন্ত এ নিয়ে অনসূয়ার কত কথা আমার সঙ্গে। অনসূয়া বলত—রাস্তা চিনতে পারলে না?
—না।
—তখন কী করলে? আমাদের গদির ঠিকানা মনে এল না?
—নাঃ।
—আহা, তখন তোমার মনে কী হল? আমি জানতাম না তুমি ওরকম—আর কখনো তোমাকে রাঁচি নিয়ে আসব না।
—তাই তো।
—মোটরবাসে উঠেছিলে কেন?
—ভাবলাম ভরহেচ নগরে যাই, ভুল হয়ে গেল সেখানেও।
অনসূয়া বাই ও ওরা এই ঘটনার পরে যেন আমাকে বেশি করে জড়িয়ে ধরলে। আমিও ওদের আঁকড়ে ধরলাম। এত যখন ওদের স্নেহ, তখন আর কোথাও ওদের ছেড়ে যাব না। যা ঘটে ঘটুক ভবিষ্যতে, রইলাম এখানেই।
বৈশাখ মাসের শেষ। ভীষণ গরমের পর একপশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়ে কুরচিফুলের সুবাস ভেসে আসচে বন থেকে।
রামলাল আমায় ডাকিয়ে বললে-পেট-মে থোড়া দরদ উঠা হ্যায়, দেখো তো ই-ধার আ কর—
রামলালের মুখ-চোখের অবস্থা যেন কেমন-কেমন। রাত্রে কিছু খেতে বারণ করলাম। বুড়ো বয়সের অসুখ…ক্রমেই পেটের ব্যথার বৃদ্ধি…তার সঙ্গে জ্বর।
সে-রাত্রে বুড়ো আমার বললে-বেটা, তুমি এখানে রইলে। সব ভার তোমার ওপর। এ জায়গাতে লোক বসাবে। বড়ো সুন্দর জায়গা এটা, তোমরা ছেড়ো না।
—আপনি মনে ভয় খাচ্চেন কেন? অসুখ সেরে যাবে। আমি রাঁচি চলে যাচ্চি এখুনি, ডাক্তার আনি—
-ও-সব বাত ছোড়ো। আমার বড়ো সুখ চৈন সে দিন বীত গিয়া এই বনের মধ্যে! তুলসীজি বলিয়েসেন—শোভিত দণ্ডক কি রুচি বনী
—আচ্ছা থাক ও-সব কথা। এখন আমাকে ডাক্তার আনতে যেতে হবে।
শেষরাত্রে রামলাল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলে। কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মৃত্যুর দু-ঘণ্টা আগে, নয়তো ও ঠিক ভরহেচ নগরের কথা বলত।
এর পরের কথা খুব সংক্ষিপ্ত। অনসূয়ার স্বামী এসে এদের নিয়ে গেল। অত বড়ো বাড়িতে চাকরবাকর ছাড়া কেউ রইল না। আমি ছিলাম বৃদ্ধ রামলালের মৃত্যুর সময়ের ছবি মনে করে। অনসূয়া বাই আমাকে থাকতে বলেছিল। থাকতাম হয়তো, দু-মাস পরে ভরহেচ নগর বিক্রি হয়ে গেল ওদের ফার্মের দেনার দায়ে। বন আবার নগরীকে গ্রাস করেছে।
গল্প: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়