অপুষ্টি বলতে শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি, বিকাশ ও সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির ঘাটতি এবং অতিরিক্ততা দুটোকেই বোঝানো হলেও, সাধারণত পুষ্টির ঘাটতিজনিত অবস্থাই বোঝানো হয়। খাদ্যে এক বা একাধিক বিশেষ করে আমিষ উপাদানের অভাব, অর্থাৎ সুষম খাদ্যের দীর্ঘ অভাবই অপুষ্টির অন্যতম কারণ।
খাদ্যাভাসের পরিবর্তন
গত কয়েক দশকে খাদ্যশস্য, ডাল, শাকসবজি, ফল, মাছ, মাংস, দুধ ও তেল আহার যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে। দানাশস্য ও ডালের খাওয়ার পরিমাণ যথাক্রমে ১৯৬২-৬৪ সালের ৫৪৬ গ্রাম থেকে ১৯৯১-৯২ সালে ৪২৭ গ্রাম এবং ১৯৩৭ সালের ৪০ গ্রাম থেকে ১৯৯১-৯২ সালে ৭ গ্রাম হয়ে গেছে। শাকসবজি গ্রহণও ১৯৩৭ সালের ২৮৪ গ্রাম থেকে ১৯৯১-৯২ সালে ১৭৬ গ্রামে নেমে এসেছে। ফল, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম ও তেল খাওয়া কমে যাওয়াসহ মোট খাদ্যগ্রহণও হ্রাস পেয়েছে, যা গোটা সমাজ ও জাতির জন্য এক বড় সমস্যা। অপুষ্টিতে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশু, গর্ভবতী ও দুগ্ধদাত্রী মায়েরা।
অপুষ্টির কারণসমূহ
শুধু সীমিত ক্রয়ক্ষমতাই অপুষ্টির কারণ নয়। খাদ্যগ্রহণের সমস্যা, গলাধঃকরণের অসুবিধা, পরিপাকের সমস্যা, শোষণের সমস্যা এবং বিপাকের সমস্যাদিও অপুষ্টির কারণ হতে পারে। এছাড়া, পুষ্টি বিষয়ক জ্ঞানের অভাব, খাদ্য সম্পর্কে কুসংস্কার, চিরাচরিত খাদ্যাভ্যাস, অবৈজ্ঞানিকভাবে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রান্না, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পক্ষপাতমূলক খাদ্য বণ্টন, খাদ্যে ব্যাপক ভেজাল, মাতৃদুগ্ধদান বিরতির রেওয়াজ, পেটে কৃমি এবং অন্যান্য কিছু কারণে পুষ্টির মানের যথেষ্ট অবনতি ঘটেছে।
পুষ্টির ঘাটতি ও এর প্রভাব
জনসংখ্যার প্রায় ৬৯% ভুগছে আয়োডিনের অভাবে এবং ৯% এর ক্ষেত্রে দেখা যায় গলগন্ড। প্রায় ৫ লক্ষ লোকের রয়েছে আয়োডিনের অভাবজনিত মানসিক জড়তা। এছাড়া আয়রন ও ফলিক এসিডের অভাবে রক্তশূন্যতা এবং ভিটামিন ‘বি-২’ এর অভাবে মুখ ও জিহ্বায় ঘা দেখা যায়।
শিশুদের অপুষ্টি
বাংলাদেশ সম্প্রতি খাদ্যে, প্রধানত ধান ও গম উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠলেও মা-বাবার ক্রয়ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার দরুন উপযুক্ত খাদ্য শিশুদের নাগালে পৌঁছায় না। অধিকন্তু, সুষম বৃদ্ধির জন্য কেবল ভাত প্রয়োজনীয় পুষ্টি যোগাতে পারে না। এজন্য দরকার মাছ, মাংস, দুধ ও ডিমের মতো প্রোটিন এবং ভিটামিন ও খনিজ লবণসমৃদ্ধ ফলমূল ও শাকসবজি।
শিশুদের পুষ্টির অবস্থা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩০% এবং শিশুদের ৪৮% অপুষ্টিতে আক্রান্ত। দেশের ০-৭২ মাস বয়সী শিশুদের মধ্যে মাত্র ৬.২% স্বাভাবিক, বাকি প্রায় ৯৩.৮% নানা ধরনের অপুষ্টিজনিত রোগব্যাধির শিকার। দেহের উচ্চতা ও ওজনভিত্তিক শ্রেণিকরণ পদ্ধতি অনুযায়ী ১৯৭৫-১৯৯০ সাল পর্যন্ত সময়কালে স্বাভাবিক উচ্চতা ও ওজনসম্পন্ন শিশুদের অনুপাত কিছুটা বাড়লেও দুর্বল ও দেহের ব্যাহত বৃদ্ধি হার অপরিবর্তিত রয়েছে।
লিঙ্গবৈষম্য ও অপুষ্টি
লিঙ্গবৈষম্যগত বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, একই বয়সের ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা এবং শহরের শিশুদের তুলনায় গ্রামের শিশুরা অধিক অপুষ্ট। এক বছরের কমবয়সী শিশুমৃত্যুর হার এখন নিম্নমুখী হলেও পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুদের ৫০-৬০% মারা যায় অপুষ্টির কারণে।
মাতৃদুগ্ধ ও শিশুর পুষ্টি
শালদুধ বর্জন বহুদৃষ্ট, সম্পূর্ণ মাতৃদুগ্ধনির্ভর শিশু প্রায় ৪%। শহরাঞ্চলে প্রায় ৯০% মা শিশুদের বোতলে দুধ খাওয়ায়। গর্ভবতী নন এমন মায়েদের গড় ওজন ও উচ্চতা যথাক্রমে ৩৯ কেজি এবং ১৪৮ সেমি। প্রত্যেক সন্তান জন্মের পর মায়ের ওজন কমে ১ কেজি। বয়ঃপ্রাপ্ত নারীর প্রায় ৭৪% এবং গর্ভবতী ও দুগ্ধদাত্রী মায়ের প্রায় ৮০% আয়রন ও ফলিক এসিডের অভাবে রক্তশূন্যতায় ভোগে।
অপুষ্টি ও শিশু মৃত্যুহার
শিশুমৃত্যুর প্রায় এক-তৃতীয়াংশের কারণ মারাত্মক অপুষ্টি। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মধ্যে এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনা অনেক বেশি। এছাড়া ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবে প্রতি বছর প্রায় ৩০,০০০ শিশু অন্ধ হচ্ছে।
সমাধানের উপায়
অপুষ্টি সমস্যা মোকাবিলায় সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালিত হয়েছে। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (EPI) এবং আয়োডিনযুক্ত লবণ চালু করা হয়েছে। শাকসবজি ও ফলমূল বাড়ির আঙিনায় ফলানো, মাতৃদুগ্ধপান উৎসাহ প্রদান কর্মসূচি এবং উচ্চশক্তির ‘এ’ ভিটামিন ক্যাপসুল প্রদান করা হয়েছে।
অপুষ্টি বাংলাদেশের এক বড় সমস্যা হলেও সচেতনতা ও সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এর সমাধান সম্ভব। পুষ্টি বিষয়ক জ্ঞানের বিস্তার এবং সুষম খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে আমরা একটি সুস্থ ও সবল সমাজ গড়ে তুলতে পারি।