জীবনধারা রচনা

হিন্দু বিয়ে: একটি ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান

0

হিন্দু বিয়ে, যা বিবাহ (দেবনাগরী: विवाह; বিবাহ) নামে পরিচিত, মারাঠিতে লগ্ন (लग्न), বাংলায় বিবাহ (বিবাহ), তেলুগুতে কল্যাণম (కళ్యాణం), কন্নড়ে মধুভে (ಮದುವೆ), তামিলে তিরুমনম (திருமணம்), অথবা পেল্লি (తెలుగు: పెళ్లి) নামে পরিচিত, হিন্দুদের জন্য একটি ঐতিহ্যবাহী বিবাহ অনুষ্ঠান। এই বিবাহ অনুষ্ঠানগুলি অত্যন্ত রঙিন এবং উদযাপনগুলি বেশ কয়েক দিন ধরে চলতে পারে এবং সাধারণত বিপুল সংখ্যক লোক উপস্থিত থাকে। বরের এবং কনের বাড়ি—প্রবেশপথ, দরজা, দেয়াল, মেঝে, ছাদ—কখনও কখনও রঙ, ফুল এবং অন্যান্য সাজসজ্জায় সজ্জিত থাকে।

উৎপত্তি এবং গুরুত্ব

বিবাহ শব্দটি বৈদিক ঐতিহ্য অনুযায়ী দুই ব্যক্তির পবিত্র মিলনকে বোঝায়, যা অনেকেই বিবাহ বলে অভিহিত করেন, তবে এটি মহাজাগতিক নিয়ম এবং প্রাচীন অনুশীলনের উপর ভিত্তি করে। বৈদিক হিন্দু ঐতিহ্য অনুযায়ী, বিবাহ একটি আজীবন অঙ্গীকার যা একটি স্ত্রী এবং একটি স্বামীর মধ্যে সম্পাদিত হয়। ভারতে, বিবাহকে মহাজাগতিকভাবে ডিজাইন করা হয়েছে বলে মনে করা হয় এবং এটি “অগ্নির সাক্ষী হিসাবে একটি পবিত্র একতা” হিসাবে বিবেচিত হয়। ঐতিহ্যগতভাবে, হিন্দু পরিবারগুলি পিতৃতান্ত্রিক হয়ে থাকে।

ঐতিহাসিক পটভূমি

ঔপনিবেশিক যুগে আর্য সমাজ আন্দোলন উত্তরাঞ্চলে হিন্দু প্রবাসীদের মধ্যে বৈদিক বিবাহ শব্দটি জনপ্রিয় করে তুলেছিল, যদিও এটি দক্ষিণ ভারতে পূর্ব থেকেই প্রচলিত ছিল। এই ঐতিহ্যের শিকড় রিগ্বেদ শাকলা সংহিতার স্তোত্র ১০.৮৫-এ পাওয়া যায়, যা “রিগ্বেদীয় বিবাহ স্তোত্র” নামেও পরিচিত।

বিবাহের রীতিনীতি এবং প্রক্রিয়া

হিন্দু বিবাহের রীতিনীতি এবং প্রক্রিয়া অঞ্চল এবং সম্প্রদায় অনুযায়ী ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। তবে, মূলত হিন্দু বিবাহ অনুষ্ঠানটি একটি বৈদিক যজ্ঞ অনুষ্ঠান, যার তিনটি প্রধান রীতিনীতি প্রায় সার্বজনীন:

  1. কন্যাদান: পিতার দ্বারা কন্যার দান।
  2. পাণিগ্রহণ: আগুনের সামনে হাত ধরে মিলনের প্রতীকী রীতি।
  3. সপ্তপদী: আগুনের চারপাশে সাতটি পদক্ষেপ নেওয়া, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ একটি সম্পূর্ণ প্রদক্ষিণ হিসাবে গণ্য হয় এবং প্রতিটি পদক্ষেপে প্রতিশ্রুতি করা হয়।

হিন্দু বিবাহের প্রধান সাক্ষী হল অগ্নি দেবতা, পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুদের উপস্থিতিতে। অনুষ্ঠানটি ঐতিহ্যগতভাবে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে সংস্কৃত ভাষায় পরিচালিত হয়, যা হিন্দুদের পবিত্র অনুষ্ঠানের ভাষা হিসাবে বিবেচিত হয়। কনে এবং বরের স্থানীয় ভাষাও ব্যবহার করা যেতে পারে।

প্রধান রীতিনীতির বর্ণনা

কন্যাদান

এই মূল রীতিতে, পিতা কন্যাকে বরের হাতে তুলে দেন। যদি পিতা না থাকেন, তাহলে কন্যার নির্বাচিত অভিভাবক এই রীতিটি সম্পাদন করেন। পিতা কন্যার হাত বরের হাতে তুলে দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করেন। বর কন্যার হাত গ্রহণ করেন এবং কাম-সুক্ত স্তোত্র পাঠ করা হয়।

পাণিগ্রহণ

কন্যাদানের পরে পাণিগ্রহণ রীতি পালন করা হয়, যেখানে বর কনের হাত ধরে মিলনের প্রতীকী রীতি সম্পাদন করেন। বর চারটি দেবতার প্রতি দায়িত্ব স্বীকার করেন: ভগ (সম্পদ), আর্যমা (স্বর্গ), সভিতা (উজ্জ্বলতা), এবং পুরন্ধি (জ্ঞান)। বর পশ্চিমমুখী হন এবং কনে পূর্বমুখী হয়ে বসেন, এবং একে অপরের হাত ধরে রিগ্বেদ মন্ত্র পাঠ করেন।

সপ্তপদী

সপ্তপদী হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রীতি। দম্পতি পবিত্র আগুনের চারপাশে সাতটি পদক্ষেপ নেন, একে অপরকে প্রতিশ্রুতি দেন। প্রতিটি প্রদক্ষিণ বর এবং কনে পালাক্রমে নেতৃত্ব দেন, যা তাদের যৌথ যাত্রা এবং দায়িত্বের প্রতীক। সপ্তপদী সম্পন্ন হওয়ার পরে তারা স্বামী-স্ত্রী হিসাবে বিবেচিত হন।

বিয়ের আগে এবং পরে রীতি-নীতি

বিয়ের আগে এবং পরে রীতি-নীতি অঞ্চল, পছন্দ এবং সম্পদ অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। বিয়ের আগে অনুষ্ঠানের মধ্যে এনগেজমেন্ট, বরযাত্রা, এবং অন্যান্য রীতি যেমন অভিষেক, অন্নপ্রাশন, আশীর্বাদ, এবং গৃহপ্রবেশ অন্তর্ভুক্ত।

আইনগত এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

ভারতে, আইন এবং ঐতিহ্য অনুযায়ী, সাত পাকে এবং অগ্নির উপস্থিতিতে অনুষ্ঠান সম্পন্ন না হলে কোন হিন্দু বিবাহ বৈধ নয়। এই প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, কারণ কিছু হিন্দু সম্প্রদায় এই রীতি পালন করে না।

বিবাহ সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক মিলন হিসেবে

বেদের মতে, বিবাহ হল পুরুষ এবং নারীর মধ্যে একটি মিলন যা একসাথে ধর্ম (দায়িত্ব), অর্থ (সম্পদ), কাম (ইচ্ছা), এবং মোক্ষ (মুক্তি) অনুসরণ করে। এটি একটি সংবেদনশীল আনন্দ, অগ্রগতি, সমৃদ্ধি এবং আনন্দ উদযাপন এবং একজনের কর্মগত অভিজ্ঞতার পরবর্তী স্তরে উত্তরণের উদযাপন হিসেবে বিবেচিত হয়। সমাজ এটি স্বীকৃতি দেয় এবং গুণগত নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করে কারণ এটি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বৃদ্ধি প্রভাবিত করে। মনুস্মৃতিতে বিবাহের আটটি প্রকার উল্লেখ আছে, যাদের মধ্যে সবগুলি ধর্মগ্রন্থ দ্বারা অনুমোদিত নয়।

উপসংহার

হিন্দু বিবাহ একটি সমৃদ্ধ এবং অর্থবহ অনুষ্ঠান যা গভীর সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিক গুরুত্ব বহন করে। এটি একটি রঙিন উদযাপন যা বহু রীতি-নীতি এবং ঐতিহ্যগুলির মাধ্যমে দুটি ব্যক্তিকে এবং তাদের পরিবারকে একত্রিত করে, তাদের জীবনের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। অনুষ্ঠানটি আজীবন অঙ্গীকার, ঐক্য, এবং একসাথে আধ্যাত্মিক এবং জাগতিক লক্ষ্য সাধনের উপর জোর দেয়।

অন্ত্যেষ্টি: হিন্দুধর্মের শেষ অনুষ্ঠান
ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র: হিন্দু সাধক ও সৎসঙ্গ আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা (১৮৮৮-১৯৬৯)

Editors’ Choice

Reactions

0
0
0
0
0
0
ইতিমধ্যে এই পোস্টের জন্য প্রতিক্রিয়া করা হয়েছে।

Nobody liked ?

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

GIF