এল্ডারমিল নামে ছোট্ট একটি শহরে ছিল বিখ্যাত ঘড়ি নির্মাতা মিস্টার হার্পার। তার তৈরি ঘড়িগুলো শুধু সময় দেখাত না, সেগুলো ছিল একেকটি শিল্পকর্ম—প্রতিটি ঘড়ির ভেতরে থাকা চাকার মতো যন্ত্রাংশগুলো যেন জাদুর মতো কাজ করত। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ তার ঘড়ি দেখতে আসত, কিন্তু কেউ কখনো তার রহস্য জানত না।
একদিন এক কিশোর, লিও, মিস্টার হার্পারের দোকানের দরজায় কড়া নাড়ল।
“স্যার, আমি আপনার মতো ঘড়ি বানাতে শিখতে চাই,” লিও বলল। তার হাতে ছিল একটি ভাঙা পকেট ঘড়ি।
মিস্টার হার্পার তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে লিওর দিকে তাকালেন। “তুমি শিখতে চাও কেন?”
লিও একটু দ্বিধা করল, তারপর বলল, “কারণ সময় অনেক মূল্যবান। যদি আমি মানুষের সময়কে আরও বেশি মূল্যবান করে তুলতে পারি, সেটা ভালো কাজ হবে।”
লিওর আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে মিস্টার হার্পার তাকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করলেন।
শুরু হলো শিক্ষা
লিও ভেবেছিল সে প্রথম দিনেই ঘড়ি বানানো শুরু করবে, কিন্তু পরিবর্তে মিস্টার হার্পার তাকে ছোট ছোট কাজ দিলেন—পিতল পালিশ করা, ছোট স্ক্রু আলাদা করা আর আকাশের তারা পর্যবেক্ষণ করা।
“এগুলো কেন করছি?” একদিন বিরক্ত হয়ে লিও জিজ্ঞেস করল।
“ধৈর্য ধরো,” মিস্টার হার্পার বললেন। “একজন ঘড়ি নির্মাতাকে ছোট ছোট অংশের গুরুত্ব বুঝতে হবে। ঘড়ির সবচেয়ে ছোট চাকারও মূল্য আছে।”
দিন কেটে গেল, সপ্তাহ গড়াল, এবং লিও বুঝতে শুরু করল এই কারিগরির সৌন্দর্য। ছোট যন্ত্রাংশের জটিল নৃত্য এবং ভারসাম্যপূর্ণ কাজগুলো তাকে মুগ্ধ করল। কিন্তু একটা জিনিস তাকে ভাবিয়ে তুলল—দোকানের পেছনের লক করা ওয়ার্কশপ।
“ওই ঘরে ঢুকতে পারি না কেন?” একদিন সে জানতে চাইল।
মিস্টার হার্পার রহস্যময় হাসি দিয়ে বললেন, “সময় এলে তুমি জানতে পারবে।”
ভাঙা ঘড়ির চ্যালেঞ্জ
এক ঝড়ো সন্ধ্যায় এক ভ্রমণকারী দোকানে এসে হাজির হলো। তার হাতে ছিল একটি পুরনো ঘড়ি যার কাঁচ ভেঙে গিয়েছিল।
“এই ঘড়িটি আমার পরিবারের প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রয়েছে,” তিনি বললেন। “আপনি কি এটা ঠিক করতে পারবেন?”
মিস্টার হার্পার ঘড়িটি পরীক্ষা করে লিওর হাতে তুলে দিলেন। “এটাই হবে তোমার প্রথম বড় পরীক্ষা।”
লিওর হাত কাঁপছিল। ঘড়ির ভেতরের যন্ত্রাংশগুলো এত জটিল ছিল যে সে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না কীভাবে ঠিক করবে। কয়েকদিন চেষ্টা করার পর হতাশ হয়ে সে বলল, “আমি যদি এটা ঠিক করতে না পারি?”
মিস্টার হার্পার লিওর কাঁধে হাত রেখে বললেন, “প্রতিটি ঘড়ির নিজস্ব ছন্দ আছে। তার কথা শোনো। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো।”
লিও নতুন উদ্যমে কাজ করল, এবং একদিন ঘড়িটি আবার চলতে শুরু করল। ঘড়ির টিকটিক শব্দ শুনে ভ্রমণকারীর মুখে হাসি ফুটল, আর লিওর মনে গর্বের অনুভূতি জন্ম নিল।
চূড়ান্ত পরীক্ষা
পরের দিন সকালে মিস্টার হার্পার লিওকে নিয়ে গেলেন সেই লক করা ওয়ার্কশপে। সেখানে একটি বিশাল ঘড়ি রাখা ছিল, এত বড় যে লিও কখনো কল্পনাও করেনি। ঘড়িটির শত শত অংশ একসঙ্গে নড়ছিল, যেন জীবন্ত ছিল।
“এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কাজ,” মিস্টার হার্পার বললেন। “এটা একটি চিরস্থায়ী ঘড়ি—যেটা কখনো থামে না, কখনো ওঠানো লাগে না। কিন্তু এর শেষ অংশটি এখনও বাকি।”
তিনি লিওর হাতে একটি ছোট সোনার গিয়ার তুলে দিলেন। “এটাকে সঠিক জায়গায় বসাতে হবে।”
লিও ঘড়ির দিকে তাকাল, তার মস্তিষ্ক দ্রুত কাজ করছিল। সে খেয়াল করল প্রতিটি অংশ যেন একে অপরের সাথে সংযুক্ত, একটা নিখুঁত বন্ধনের মতো। অবশেষে সে একটি জায়গা খুঁজে পেল যেখানে গিয়ারটি পুরোপুরি মানানসই হবে। গিয়ারটি বসাতেই পুরো ঘড়িটি জীবন্ত হয়ে উঠল—এর কাঁটা নরমভাবে ঘুরল, আর ঘন্টার সুর যেন সংগীতের মতো শোনা গেল।
“তুমি সফল হয়েছ,” মিস্টার হার্পার বললেন, গর্বিত কণ্ঠে।
শিষ্য থেকে কারিগর
বছর কয়েক পর মিস্টার হার্পার অবসর নিলেন এবং দোকানটি লিওর হাতে তুলে দিলেন। লিওর দক্ষ হাতে এল্ডারমিলের ঘড়িগুলো আবার নতুন প্রাণ পেল। মানুষ বলত, লিও শুধু সময় দেখায় না—সে সময়কে অর্থবহ করে তোলে।
গল্পের নীতি:
ধৈর্য এবং ছোট ছোট জিনিসের প্রতি মনোযোগই যে কোনো শিল্পে দক্ষতার চাবিকাঠি। কখনো কখনো সবচেয়ে ছোট অংশই সবচেয়ে বড় পার্থক্য তৈরি করে।