রচনা

অন্নপ্রাশন: হিন্দু সংস্কারের একটি গুরুত্বপূর্ণ আচার

2

অন্নপ্রাশন (সংস্কৃত: अन्नप्राशन, রোমানাইজড: annaprāśana), যা অন্নপ্রাশন বিধি বা অন্নপ্রাশনাম নামেও পরিচিত, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু সংস্কার (সংস্কার) যা একটি শিশুর দুধ ছাড়া অন্যান্য খাবার প্রথমবার গ্রহণের আচারকে চিহ্নিত করে। অন্নপ্রাশন শব্দের অর্থ ‘সিদ্ধ ভাত খাওয়া’। বৈদিক হিন্দু সংস্কৃতিতে, অন্নপ্রাশনের আগে শিশুকে ভাত খাওয়ানো হয় না। এই আচারটি ভাতকে জীবনের ধারক এবং পবিত্র খাদ্য হিসেবে চিহ্নিত করে। বাংলাদেশ, নেপাল এবং ভারতে অন্নপ্রাশন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে পালন করা হয়। পশ্চিমবঙ্গে এটি মুখেভাত, কেরালায় চোড়ুনু এবং হিমাচল প্রদেশে ভাত খুলাই নামে পরিচিত। নেপালে এটি পাশনি নামে পরিচিত।

শব্দের উৎপত্তি

অন্নপ্রাশন শব্দটি দুটি সংস্কৃত শব্দের সমন্বয়ে গঠিত: অন্ন অর্থ ‘সিদ্ধ ভাত’ এবং প্রাশন অর্থ ‘খাওয়ানো’। ইংরেজিতে এই আচারটি গ্রেইন ইনিশিয়েশন বা রাইস-ফিডিং সিরিমনি নামে পরিচিত।

আচার সম্পর্কে বিস্তারিত

অন্নপ্রাশনের আয়োজন

অন্নপ্রাশন একটি পূজা এবং ভাত খাওয়ানোর আচার দিয়ে সম্পন্ন হয়। এটি একজন পুরোহিতের সাথে পরামর্শ করে আয়োজন করা হয়, যিনি শিশুর পাঁচ থেকে আট মাস বয়সে শুভ দিন নির্ধারণ করেন। সাধারণত, কন্যাশিশুর জন্য বিজোড় মাস (৫ বা ৭ মাস) এবং পুত্রশিশুর জন্য জোড় মাস (৬ বা ৮ মাস) শুভ মনে করা হয়।

আচার প্রক্রিয়া

অন্নপ্রাশনের দিনে শিশুকে স্নান করিয়ে, আনুষ্ঠানিক পোশাক পরিয়ে, মা-বাবার কোলে বসানো হয়। দেবতাদের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করা হয় শিশুর ভালো হজম শক্তি, ভালো বাকশক্তি এবং ভালো মানসিক বিকাশের জন্য। এরপর ভাত খাওয়ানো হয়, যা সাধারণত একটি মিষ্টি পুডিং বা ক্ষীর আকারে হয়, যা হিন্দু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে পবিত্র খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রাচীন হিন্দু গ্রন্থগুলো (স্মৃতি) এই আচার সম্পর্কে বিশদ নির্দেশনা প্রদান করে, যেমন: খাদ্যের ধরন, গুণমান, পরিমাণ এবং রান্নার প্রক্রিয়া।

আঞ্চলিক ভিন্নতা

বাঙালি হিন্দু সংস্কৃতি

বাঙালি হিন্দু সংস্কৃতিতে, অন্নপ্রাশন একটি বিশদ আচার যা মুখেভাত বা মামাভাত নামে পরিচিত। শিশুর মামা বা মাতামহ তাকে ভাত খাওয়ান। এই অনুষ্ঠানটি মামা বা মাতামহের বাড়িতে বা একটি বড় অনুষ্ঠান হিসেবে ব্যাংকোয়েট হলে আয়োজন করা হয়। ধর্মীয় আচার (পূজা) একই অনুষ্ঠানে বা বড় অনুষ্ঠানের আগে আলাদা ভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারে। ভাত খাওয়ানোর সময় শিশুদের ঐতিহ্যবাহী মাথার পোশাক (টোপর) এবং বিভিন্ন ধরনের খাদ্য, যেমন: ক্ষীর, পাঁচ ধরনের ভাজা এবং মাছের পদ প্রস্তুত করা হয়। ক্ষীর সাধারণত শিশুর মা বা দাদি দ্বারা প্রস্তুত করা হয় এবং রুপার পাত্রে পরিবেশন করা হয়। শঙ্খধ্বনি হয় এবং মহিলারা উলুধ্বনি দেন যখন শিশুর মামা বা মাতামহ তাকে ভাত খাওয়ান।

ভাত খাওয়ানোর পরে, একটি খেলা খেলা হয় যেখানে শিশুকে একটি কলাপাতা বা রুপার প্লেটে কিছু প্রতীকী বস্তু দেওয়া হয়: মাটি (সম্পত্তি), বই (শিক্ষা), কলম (জ্ঞান) এবং মুদ্রা (সম্পদ)। প্রচলিত বিশ্বাস হল, শিশুটি যে বস্তুটি তুলে নেয় তা তার ভবিষ্যতের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশ করে। শিশুর বয়স্ক আত্মীয় এবং অতিথিরা পরে শিশুকে ক্ষীর খাইয়ে আশীর্বাদ প্রদান করেন।

মালয়ালি সংস্কৃতি

মালয়ালি সংস্কৃতিতে, অন্নপ্রাশন চোড়ুনু বা চোড়ুনাল নামে পরিচিত এবং এটি শিশুর ছয় মাস বয়সে মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয়। চোড়ু অর্থ ‘ভাত’ এবং উন্নুকা অর্থ ‘খাওয়া’। শিশুকে ঐতিহ্যবাহী কসাভু পোশাক পরিয়ে, একজন কাকা বা পিতার কোলে বসিয়ে, মন্দিরের পুরোহিত দ্বারা চন্দন, তুলসী পাতা এবং ফুল দিয়ে আশীর্বাদ করা হয়। শিশুর সামনে কলাপাতায় ভাত বা ক্ষীর এবং কলা পরিবেশন করা হয়, এবং শিশুর কাকা, বাবা বা দাদু তাকে প্রথম খাওয়ান। এছাড়াও, শিশুর বাবা প্রতিটি খাদ্যবস্তুতে সোনার আংটি ডুবিয়ে শিশুর জিহ্বায় স্পর্শ করেন। ভাত খাওয়ানোর পরে একটি মজার তুলাভারা আয়োজন করা হয় যেখানে শিশুর ওজন মেপে পরিবারের উপহারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হয়।

উপসংহার

অন্নপ্রাশন হিন্দু সংস্কৃতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ আচার, যা শিশুর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়। আচার-অনুষ্ঠান এবং প্রথাগুলো আঞ্চলিকভাবে ভিন্ন হলেও, শিশুর স্বাস্থ্য, বিকাশ এবং ভবিষ্যতের জন্য আশীর্বাদ কামনা করা এই সুন্দর আচারটির মূল উদ্দেশ্য।

ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র: হিন্দু সাধক ও সৎসঙ্গ আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা (১৮৮৮-১৯৬৯)
অপুষ্টি: বাংলাদেশের এক বিশাল সমস্যা

Reactions

0
0
0
0
0
0
ইতিমধ্যে এই পোস্টের জন্য প্রতিক্রিয়া করা হয়েছে।

Who liked ?

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

GIF