অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় (২৪ জুলাই ১৯৩১ – ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২) বাংলা সঙ্গীতের স্বর্ণযুগের একজন খ্যাতনামা সুরকার ও গীতিকার ছিলেন। তাঁর সুরের মাধুর্য এবং সৃষ্টিশীলতা বাংলা আধুনিক গানের জগতে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে।
জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩১ সালের ২৪ জুলাই উত্তর কলকাতার একটি ব্রাহ্ম পরিবারে। তবে তাঁর শৈশব ও বাল্যকাল কেটেছে দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ায়। রামচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। তাঁর পরিবারে সঙ্গীতের পরিবেশ ছিল প্রবল; পিতা নিরাময় বন্দ্যোপাধ্যায়সহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও সঙ্গীতের সাথে যুক্ত ছিলেন। মেজো জ্যাঠা নিরুপম বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ধ্রুপদী সঙ্গীতশিল্পী, আর মাতা লাবণ্য বন্দ্যোপাধ্যায় অর্গানে তথা হারমোনিয়াম বাজাতেন। অগ্রজ অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায়ও ছিলেন সঙ্গীতশিল্পী ও গীতিকার। এই পরিবেশে অভিজিৎ ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং অগ্রজের কাছে সঙ্গীতে হাতেখড়ি নেন। অগ্রজের রচিত এক গানে প্রথম সুরারোপ করেন, যা রবীন্দ্রসঙ্গীতের ধাঁচে ছিল।
সঙ্গীত জীবন
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গীতজগতে আত্মপ্রকাশ ঘটে ভারতীয় গণনাট্যের মাধ্যমে। এখানে তিনি সলিল চৌধুরীর সহকারী ও শিষ্য হিসেবে কাজ করেন। সলিল চৌধুরীর “স্যাটেলাইট” হিসেবে পরিচিত তিনজনের মধ্যে তিনি একজন; অন্য দুজন ছিলেন অনল চট্টোপাধ্যায় ও প্রবীর মজুমদার। প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী সুবীর সেনের সতীর্থ হিসেবে তিনি উষারঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নেন এবং ভি বালসারার কাছে পিয়ানো শেখেন। সরকারি চাকরির পাশাপাশি সঙ্গীতচর্চা চালিয়ে যান। বাংলা গানের জগতে তাঁর পরিচিতি ঘটে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের “দূরের পাল্লা” কবিতায় সুরারোপ করে, যা শ্যামল মিত্রের কণ্ঠে জনপ্রিয়তা পায়।
১৯৪৯ সালে অনল চট্টোপাধ্যায়ের কথা ও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে “কোথায় সোনার ধান” গানটি প্রকাশিত হলে জনমানসে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এরপর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সনৎ সিংহ, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সুবীর সেনসহ প্রবাদপ্রতিম শিল্পীদের কণ্ঠে তাঁর সুরারোপিত গান শোনা যায়। তাঁর সঙ্গীত পরিচালনায় চলচ্চিত্রে গেয়েছেন মান্না দে, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলের মতো কিংবদন্তি শিল্পীরাও। তাঁর সঙ্গীত পরিচালনা শুরু হয় ১৯৬৮ সালে “অশ্রু দিয়ে লেখা” ছবিতে। তবে বাংলা আধুনিক গানের তুলনায় বাংলা ছবিতে তাঁর কাজের সংখ্যা কম। তিনি শেষ সঙ্গীত পরিচালনা করেন ২০০০ সালে “ঋণমুক্তি” ছবিতে। তাঁর সুরারোপে শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় “মৌনমুখর” ছবিতে কিশোর কুমারের কণ্ঠে দুটি গান “সেই তানপুরা আছে, ছিঁড়ে গেছে তার” এবং “আহা কথক নাকি কথাকলি” সুপারহিট হয়। ঐ একই ছবিতে কিশোর কুমার ও অনুরাধা পাড়োওয়ালের দ্বৈত কণ্ঠে “শিলঙের পাইন বনে বনে” গানটিও অসম্ভব জনপ্রিয় হয়।
সাহিত্যকর্ম
জীবনে গান লিখেছেন অনেক, আর রচিত গানের ইতিবৃত্ত নিয়ে রচনা করেছেন “কিছু ভাবনা কিছু কথা” গ্রন্থ। গানের পাশাপাশি লিখতেন কবিতাও। তাঁর লেখা একমাত্র কাব্যগ্রন্থটি হল “ঝড়ের রাতের পাখি”। তবে বাংলা গানের আকর গ্রন্থ হল “বাংলা গানের পথ চলা” যার প্রতিটি কবিতায় রয়েছে মানব জীবন যাপনের প্রতিটি মুহূর্ত আর সংগ্রামী মানুষের ছবি। এখানেই তিনি রবীন্দ্রনাথকে চিহ্নিত করেন আধুনিক বাংলা গানের দিশারী হিসেবে। তাঁর আর একটি গ্রন্থ হল “অকিঞ্চনের কড়চা”।
জীবনাবসান
আধুনিক বাংলা গানের সুরের নিপুণ কারিগর সুরকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বার্ধক্যজনিত রোগে বেশ কিছুদিন ভুগছিলেন। কয়েকদিন হাসপাতালে ভর্তিও হয়েছিলেন এবং পরে বাড়িতে ফিরে আসেন। কিন্তু ২০২২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসের সকালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর দুই পুত্র অমিত ও অভিষেক এবং এক কন্যা মহাশ্বেতা সকলেই সঙ্গীতের সাথে যুক্ত। সঙ্গীতশিল্পী অগ্নিভ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র।