অনুকূলচন্দ্র চক্রবর্তী, যিনি ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র নামেও পরিচিত, ছিলেন এক বিশিষ্ট হিন্দু সাধক, চিকিৎসক এবং সৎসঙ্গ আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ১৮৮৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পাবনা জেলার হেমায়েতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শিবচন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন একজন ঠিকাদার এবং মাতা মনোমোহিনী দেবী ছিলেন ভগবদ্ভক্তিতে পূর্ণ একজন মহীয়সী নারী।
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা
অনুকূলচন্দ্র পাবনা ইনস্টিটিউশনে নবম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করার পর পশ্চিমবঙ্গের নৈহাটি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল স্কুল থেকে হোমিওপ্যাথিতে ডিগ্রি অর্জন করে নিজ গ্রামে প্র্যাক্টিস শুরু করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন: মানুষ শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক এ তিন প্রকার ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। তাই তিনি মানসিক ব্যাধির চিকিৎসার প্রতিই বেশি জোর দিতেন, কারণ শারীরিক সুস্থতা অনেকটাই মানসিক সুস্থতার ওপর নির্ভর করে।
উচ্চশিক্ষা ও কর্মজীবন
তিনি অল্প সময়ের জন্য অমিতাবাদের রায়পুর উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়েন এবং পরে পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনার নৈহাটি উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। পরে তিনি কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান হোমিওপ্যাথিতে ডিগ্রি অর্জন করে।
আত্মিক উন্নয়ন ও কীর্তনদল গঠন
মায়ের নিকট দীক্ষা নেওয়ার পর অনুকূলচন্দ্র মানুষের আত্মিক উন্নয়নের জন্য কীর্তনদল গঠন করেন। কীর্তনের সময় তিনি মাঝে মাঝে দিব্যভাবে আবিষ্ট হয়ে পড়তেন। ওই সময় তাঁর মুখ থেকে উচ্চারিত বাণীসমূহ পরে সংগৃহীত হয়ে পুণ্যপুঁথি নামে প্রকাশিত হয়। তখন থেকেই লোকে তাঁকে ‘ঠাকুর’ বলে সম্বোধন করত।
সৎসঙ্গ আশ্রম প্রতিষ্ঠা
সত্যনিষ্ঠা, সৎকর্মানুষ্ঠান এবং দীক্ষা গ্রহণের মধ্য দিয়ে মানুষের আত্মিক উন্নতি বিধানের উদ্দেশ্যে তিনি পাবনায় প্রতিষ্ঠা করেন সৎসঙ্গ আশ্রম। শিক্ষা, কৃষি, শিল্প এবং সুবিবাহ- এ চারটি বিষয় হলো সৎসঙ্গের আদর্শ। অনুকূলচন্দ্র লোকহিতার্থে তপোবন বিদ্যালয়, দাতব্য চিকিৎসালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, পাবলিশিং হাউজ, ছাপাখানা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করেন।
দেওঘরে সৎসঙ্গ আশ্রম
১৯৪৬ সালে তিনি বিহারের দেওঘরে যান এবং সেখানে সৎসঙ্গের আদর্শপুষ্ট একটি নতুন আশ্রম গড়ে তোলেন। ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগ হলে তিনি আর ফিরে আসেননি। অনুকূলচন্দ্র বিপুল সংখ্যক গ্রন্থ রচনা করেছেন। এক হিসাব মতে, তাঁর রচিত বাংলা গ্রন্থের সংখ্যা ৮২ এবং ইংরেজি গ্রন্থের সংখ্যা ১২। এসবের মধ্যে পুণ্যপুঁথি, অনুশ্রুতি (৬ খন্ড), চলার সাথী, শাশ্বতী (৩ খন্ড), প্রীতিবিনায়ক (২ খন্ড) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের অবদান
অনুকূলচন্দ্র তাঁর জীবদ্দশায় সমাজে বিপুল প্রভাব ফেলে গেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সৎসঙ্গ আশ্রম, তপোবন বিদ্যালয়, দাতব্য চিকিৎসালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ ইত্যাদি আজও সমাজের সেবা করে যাচ্ছে। তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহে ধর্মীয় ও সামাজিক আদর্শের বাণী ছড়িয়ে আছে, যা আজও সমাজকে আলোকিত করছে।
ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের শিষ্যসম্প্রদায়
ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের শিষ্যসম্প্রদায় এবং সৎসঙ্গের সাংগঠনিক কর্মকান্ড উভয় বাংলার নানা অঞ্চলে আজও সক্রিয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন শহরে এর আশ্রম ও কার্যালয় আছে। ১৯৬৯ সালের ২৬ জানুয়ারি বিহারের দেওঘরে তিনি পরলোক গমন করেন।
রচিত গ্রন্থসমূহ
ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র প্রায় ৪৬টি পুস্তক রচনা করেন। এগুলোতে ধর্মশিক্ষা, সমাজ সংস্কার প্রচলন প্রভৃতি বিষয়ে আদর্শ ও উপদেশসমূহ বর্ণিত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- সত্যানুসরণ
- পুণ্যপুঁথি
- অনুশ্রুতি (৬ খন্ড)
- চলার সাথী
- শাশ্বতী (৩ খন্ড)
- বিবাহ বিধায়না
- সমাজ সন্দীপন
- যতি অভিধর্ম
শেষ জীবন
ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের আধ্যাত্মিক প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দলে দলে মানুষ এসে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধী, লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, গুলজারীলাল নন্দা এই সৎসঙ্গের কর্মকাণ্ড দর্শন করে ভূয়শী প্রশংসা করেন। ১৯৬৯ সনের ২৭ জানুয়ারী তারিখে ৮১ বছর বয়সে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত আশ্রম ভারতের বিহার রাজ্যে দেওঘরে ঠাকুর দেহ ত্যাগ করেন।