গল্প

ভ্রমণকারী কাফেলার গল্প, পর্ব ৫: ভুলে যাওয়া স্বপ্নের মরুভূমি

0

পর্ব ৫: ভুলে যাওয়া স্বপ্নের মরুভূমি

সূর্য পৃথিবীর সীমানার নীচে চলে যাচ্ছিল, তার সোনালী রশ্মি আকাশে ছড়িয়ে পড়ছিল, আর সেই সঙ্গে মরুভূমির বিস্ময়কর বিশালতা দেখা যাচ্ছিল। বাতাসে হালকা বাতাস বয়ে যাচ্ছিল, যেন তপ্ত গরম মরুভূমির বালি থেকে সমস্ত পৃথিবী একেবারে প্রসারিত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, তবুও, ভ্রমণকারী কারাভান তাদের যাত্রা চালিয়ে যাচ্ছিল, তাদের চোখে দৃঢ় সংকল্প।

আলিয়া, সাধারণত শান্ত স্বভাবের, দিগন্তের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাদের পরবর্তী চ্যালেঞ্জ সামনে ছিল, একটি স্থান যা ভ্রমণকারীদের মধ্যে অস্পষ্ট কথায় শোনা যায়। এটি ছিল ভুলে যাওয়া স্বপ্নের মরুভূমি, একটি শুষ্ক, নির্জন স্থান যেখানে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে প্রবেশ করতে চায় না। কিংবদন্তী অনুসারে, এই মরুভূমি এমন একটি স্থান, যেখানে হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন এবং পরিত্যক্ত আশা স্তব্ধ হয়ে পড়ে, এবং যারা এই মরুভূমি পার হওয়ার চেষ্টা করে তারা সেই স্বপ্নগুলোর দ্বারা শোষিত হয়।

“এই মরুভূমি,” আলিয়া আস্তে করে বলল, “এটি হৃদয়ের একটি পরীক্ষা। বলা হয় যে, এখানে বালিগুলো শুধু শরীরকে পোড়ায় না, তারা আত্মায় প্রবাহিত হয় এবং আপনার যে স্বপ্নগুলো এক সময় ছিল তা ভুলিয়ে দেয়। সাবধানে থাকুন, কারণ আপনি যা হারাবেন তা হয়তো আর কখনো খুঁজে পাবেন না।”

তারিক, যিনি সবসময় সন্দিহান ছিলেন, চিন্তা করে বলল, “স্বপ্ন? আমরা স্বপ্নের পিছু ছুটছি না, আলিয়া। আমরা এখানে সত্যি খুঁজতে এসেছি। যদি এই স্থানটি শুধু এক ধরনের মায়া হয়, তবে যেমনটা আমরা সবসময় করি, সেভাবেই একে মোকাবেলা করব—সামনে।”

“আমি বিশ্বাস করি না যে এটি মায়া, তারিক,” আলিয়া উত্তর দিল, তার দৃষ্টি স্থির ছিল। “এই মরুভূমি আমাদের শক্তি নয়—এটি আমাদের অন্তরের দৃঢ়তা পরীক্ষা করে। আমরা আসলে কি চাই তা ধরতে সবচেয়ে কঠিন কাজ হতে পারে।”

যখন কারাভান মরুভূমির মধ্যে আরও গভীরে প্রবেশ করল, পরিবেশ আরও ভারী হতে লাগল। বাতাস শুষ্ক হয়ে উঠল এবং বালি থেকে ভেসে আসা তপ্ত হাওয়া তাদের মুখে আছড়ে পড়ছিল। বিশাল, নির্জন জায়গা যেন বিস্মৃতির অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিল, এবং তাদের প্রতিটি পদক্ষেপে চারপাশের পৃথিবী আরও দূরে এবং অস্বচ্ছ মনে হচ্ছিল।

কিছু ঘণ্টা পর, তারা একটি পুরনো, ভাঙাচুরা পাথরের গেট দেখতে পেল যা মরুভূমির মাঝখানে একা দাঁড়িয়ে ছিল। এটি পুরোপুরি অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল, যেন এটি একটি হারানো যুগের স্মৃতি। আলিয়া গেটের দিকে সশ্রদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে গেল এবং তার হাত পাথরের ওপর বোলানোর সঙ্গে সঙ্গে, গেটের গায়ে পুরনো ক্ষতচিহ্ন গুলির দিকে তাকাল।

“এটি প্রবেশদ্বার,” আলিয়া আস্তে বলল। “এই স্থানটিতেই শুরু হয় ভুলে যাওয়া স্বপ্নের মরুভূমির আসল পরীক্ষা।”

কারাভানের সবাই কিছুটা ভয় পেয়ে একে অপরকে তাকাল। তবে তারা আলিয়ার পথ অনুসরণ করে, অজানা পথে পদক্ষেপ ফেলল। গেটের নিচে প্রবেশ করার সাথে সাথে তাপমাত্রা হঠাৎ নিচে নেমে গেল এবং বাতাস থেমে গেল। মরুভূমি, যা এক সময় প্রচণ্ড তাপযুক্ত এবং বিরক্তিকর ছিল, এখন ঠাণ্ডা এবং অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছিল, যেন পুরো বাতাস তাদের বিরুদ্ধে চলে এসেছে।

যতটুকু এগিয়ে গেল, ততই তারা অদ্ভুত শ্বাস ফেলার শব্দ শুনতে পেল—একটি কম, অশান্ত কণ্ঠস্বর যা বাতাসের মধ্যে ভেসে আসছিল। প্রথমে, শব্দগুলো অস্পষ্ট ছিল, যেন দূরের শব্দ। কিন্তু কারাভান যতটা এগোতে লাগল, সেই শব্দগুলো আরও স্পষ্ট এবং আরো জোরাল হতে শুরু করল।

“তুমি কি মনে করো তুমি কী স্বপ্ন দেখেছিলে?” কণ্ঠস্বর যেন বলছিল। “তুমি কি মনে করতে পারো যে, তুমি কোন স্বপ্নগুলো হারিয়ে ফেলেছিলে… তুমি যেগুলো ছেড়ে দিয়েছ?”

কারাভান থেমে গেল, সবাই আশ্চর্য হয়ে একে অপরের দিকে তাকাল। তারিক মুষ্টি শক্ত করে ধরল, তার চোখে আতঙ্ক ছিল। “এটা কী? কে আমাদের সাথে কথা বলছে?”

“এটি মরুভূমি,” আলিয়া শান্ত কণ্ঠে বলল। “এগুলি ভুলে যাওয়া স্বপ্নের কণ্ঠস্বর, যেগুলো অতীতে হারিয়ে গিয়েছিল এবং যারা এখানে এসেছিল তাদের পরিত্যক্ত আশা। মরুভূমি এসব স্বপ্নকে খাওয়া শুরু করে এবং এটি আমাদের নিজেদের স্বপ্নগুলো ভুলিয়ে দিতে চেষ্টা করবে।”

লায়লা, যার মনে কিছুটা সংশয় ছিল, গভীর শ্বাস নিয়ে বলল, “কিন্তু আমরা তো আমাদের স্বপ্ন ভুলে যাইনি। আমি… আমি তো আমার স্বপ্ন হারাইনি।”

মরুভূমি যেন তার কথা শুনে উত্তর দিল, “তুমি ভুলে গেছ, লায়লা। তুমি অনেক আগেই তোমার স্বপ্নগুলো ছেড়ে দিয়েছ। তুমি কি মনে করতে পারো তোমার শান্তির স্বপ্নগুলো? তা হাওয়ার মতো ফুরিয়ে গেছে। ভুলে গেছ।”

লায়লা পিছিয়ে গেল, তার মনোযোগ ভেঙে পড়ল। “না, এটা সত্যি নয়। আমি এখনো শান্তির স্বপ্ন দেখি। আমি এখনও বিশ্বাস করি যে এটি সম্ভব।”

কিন্তু কণ্ঠস্বর চালিয়ে গেল, আরও জোরালো হয়ে। “শান্তি এক ধরনের মায়া, লায়লা। তুমি একটি এমন পৃথিবীর পিছনে ছুটছ, যা আসলে নেই।”

লায়লা একটু পিছিয়ে গেল, কিন্তু আলিয়া তার দিকে এগিয়ে গিয়ে কোমলভাবে বলল, “লায়লা, এগুলো মিথ্যা। তুমি যা বলো, তুমি তা কখনো ভুলে যাওনি। এটি শুধু মরুভূমির একটি মায়া। তুমি কখনো হারিয়ে যাবে না।”

কিছুক্ষণ পর, মরুভূমি আবার শান্ত হয়ে গেল। কণ্ঠস্বর থেমে গিয়েছিল, এবং চারপাশে এক ধরনের শূন্যতা বিরাজ করছিল। তবে তখন, তারা দেখতে পেল যে তাদের সামনে মরুভূমির শেষ সীমানা এবং সূর্য প্রথমে গগনে ওঠার লক্ষণ দিচ্ছে।

আলিয়া এগিয়ে এসে দলের দিকে মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “আমরা ভুলে যাওয়া স্বপ্নের মরুভূমি পার হয়ে গেছি। মরুভূমি আমাদের স্মৃতিগুলো চুরি করতে চেয়েছিল, কিন্তু এটি আমাদের সংকল্পকে হারাতে পারেনি। আমাদের ভিতরে যা রয়েছে, তা কোনও মায়া পরাজিত করতে পারবে না।”

তারিক মাথা নেড়ে বলল, “স্বপ্নগুলো কেবল অতীতের স্মৃতি নয়, আমাদের জন্য এগুলো একটি পথ দেখায়। আমরা কীভাবে এগুলি গ্রহণ করি এবং এগুলি এগিয়ে নিয়ে যাব, সেটাই আমাদের পরিচয়।”

লায়লা হেসে বলল, “এখন আমি বুঝতে পারছি। আমাদের স্বপ্নগুলো মরুভূমির ওপর নির্ভরশীল নয়। এগুলি জীবিত এবং যতক্ষণ আমরা বিশ্বাস রাখি, এগুলি আমাদের পথ দেখাবে।”

কারাভান তাদের যাত্রা চালিয়ে গেল, শক্তি এবং বিশ্বাসে পূর্ণ হয়ে। তারা ভুলে যাওয়া স্বপ্নের মরুভূমি পার হয়ে এসেছিল এবং তারা জানত—স্বপ্ন কেবল স্মৃতি নয়, এগুলি আমাদের চলার পথ, আমাদের যা করতে ইচ্ছুক তা বুঝতে সাহায্য করবে।

কাহিনীর শিক্ষা:

স্বপ্নগুলো শক্তিশালী, তবে সেগুলো সন্দেহ, মায়া এবং কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে। আসল পরীক্ষা হলো, আমরা কীভাবে সেগুলো ধরে রাখি, এবং আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে। স্বপ্ন কেবল অতীতের স্মৃতি নয়, এগুলি আমাদের ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক।

ভ্রমণকারী কাফেলার গল্প, পর্ব ৬: হারানো আত্মাদের শহর
ভ্রমণকারী কাফেলার গল্প, পর্ব ৪: প্রতিধ্বনির পর্বত

Reactions

0
0
0
0
0
0
ইতিমধ্যে এই পোস্টের জন্য প্রতিক্রিয়া করা হয়েছে।

Nobody liked ?

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

GIF