গল্প

ভ্রমণকারী কাফেলার গল্প, পর্ব ৬: হারানো আত্মাদের শহর

0

পর্ব ৬: হারানো আত্মাদের শহর

সূর্য অস্ত যাচ্ছিল যখন ভ্রাম্যমাণ কারাভ্যান তার যাত্রা চালিয়ে যাচ্ছিল। ভুলে যাওয়া স্বপ্নের মরুভূমি অতিক্রম করার পর তারা এখন একটি নতুন এবং আরও রহস্যময় গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল – হারানো আত্মাদের শহর। এটা ছিল একটি প্রাচীন শহর, একসময় যা প্রাণবন্ত ছিল, কিন্তু এখন তা সময়ের হাত থেকে হারিয়ে গেছে, তার রাস্তাগুলো খালি, তার ভবনগুলো ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে।

আলিয়া, কারাভ্যানের নেতা, এই শহরের কিংবদন্তী শুনেছিল, কিন্তু এমনকি তিনি কখনো এই অভিশপ্ত দ্বারের কাছে যেতে সাহস করেননি। কাহিনী ছিল যে যারা এই শহরে প্রবেশ করেছে, তারা আর কখনো ফিরে আসেনি – তাদের আত্মা চিরতরে ধ্বংসাবশেষে হারিয়ে গেছে। কিন্তু, বিপদ সত্ত্বেও, তাদের সামনে আর কোনো বিকল্প ছিল না। শহরের নিঃশেষিত দেয়ালগুলোর মধ্যে সঙ্গতি ছিল তাদের খোঁজা সঠিক উত্তর।

যখন তারা শহরের কাছাকাছি পৌঁছাল, তখন বাতাস আরও ভারী হয়ে উঠল। বাতাস আর সাধারণ মরুভূমির ধূলিকণায় ভরপুর ছিল না; বরং এটি ঠাণ্ডা এবং অস্বস্তিকর হয়ে উঠছিল, এমনকি যেন শহরটি যে অতীতের মধ্যে ডুবে গেছে, সেই বিষাদে শোকার্ত।

“আমরা ফিরে যাওয়া উচিত,” লায়লা চুপচাপ বলল, তার কণ্ঠে ভয় ছিল। “এই জায়গা… এটা ভুল, আমি আমার হাড়ে অনুভব করছি। যেন পৃথিবী এখানে শোক করে।”

তরীক, যিনি সবসময় সন্দিহান থাকেন, তার কপাল কুঁচকে শহরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ভয় পেলে কোনো লাভ হবে না। আমরা এখন আর পিছিয়ে যেতে পারি না। আমাদের যা সামনে, তার মুখোমুখি হতে হবে। আমরা যদি এখনই পালিয়ে যাই, তা হলে কিছুই পাবো না।”

আলিয়া সামনে এগিয়ে গেলেন, তার মুখে দৃঢ় সংকল্পের ছাপ। “আমাদের কোনো বিকল্প নেই। আমরা যা খুঁজছি তা এখানেই, শহরের ধ্বংসাবশেষে। এটি সবকিছুর চাবিকাঠি।”

কারাভ্যান শহরে প্রবেশ করল, এবং এক অদ্ভুত নীরবতা চারপাশে। একসময় যে গর্বিত ভবনগুলো ছিল, এখন সেগুলো ভেঙে গেছে, আর তাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে শুধুই ধ্বংসের চিহ্ন। রাস্তাগুলো একসময় যেগুলো মানুষের হাসি-আনন্দে পূর্ণ ছিল, এখন একদম নিঃশব্দ, যেন এখানে কোনো প্রাণ নেই।

তারা যখন শহরের ভিতরে আরও গভীরে চলতে থাকে, তখন কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করে। মাইলো, গ্রুপের সবচেয়ে চুপচাপ সদস্য, হঠাৎ তার স্থান থেকে থেমে গেল। “আমি… আমি কিছু শুনলাম,” সে আতঙ্কিত হয়ে বলল। “একটা কণ্ঠ, আমার নাম ডাকে।”

গ্রুপ থেমে গেল, শুনতে চেষ্টা করল। প্রথমে কিছুই শোনা গেল না, কেবল বাতাসের শোকাত্মক আওয়াজ। কিন্তু তারপর কণ্ঠ আবার ফিরল – খুবই দূর থেকে, বাতাসের মধ্যে ভেসে আসছিল।

“মাইলো… কাছাকাছি এসো…”

মাইলোর মুখ সাদা হয়ে গেল। “এটা আমার নাম… এটা ওদিকে থেকে আসছে,” সে অবচেতনভাবে সেই ভবনের দিকে পয়েন্ট করল, যেটি শহরের অন্য প্রান্তে ছিল।

“ওকে অনুসরণ করো না, মাইলো,” আলিয়া সতর্ক করলেন। “এই শহর তোমার মনের সঙ্গে খেলা করছে। এটা তোমাকে প্রলোভিত করছে।”

কিন্তু মাইলো, কণ্ঠে আচ্ছন্ন হয়ে, সেই ভবনের দিকে এগিয়ে গেল। বাকি গ্রুপ কিছুটা দ্বিধায় থাকলেও তাকে অনুসরণ করল, যেন তার বন্ধু একা না চলে যায়।

ভবনের ভিতরে প্রবেশ করলে, তাপমাত্রা আরও ঠাণ্ডা হয়ে যায়। শ্যাডোগুলো যেন দেয়ালে নাচছিল, অথচ কোনো আলো ছিল না। কক্ষের মাঝখানে একটি বিশাল পাথরের স্তম্ভ দাঁড়িয়ে ছিল, এবং তার উপরে একটি ঝলমলে অরব উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। কণ্ঠ, এখন আরও পরিষ্কার, কক্ষের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।

“মাইলো… তুমি ফিরে এসেছ…”

মাইলো অরবের দিকে এক পা এগিয়ে গেল, যেন তাতেই তার মন চলে গেছে। “আমি ফিরে এসেছি… আমি তোমার কাছে ফিরে এসেছি,” সে মুর্ছিতভাবে বলল, যেন একটি মন্ত্রের মতো।

হঠাৎ, পৃথিবী দুলে উঠল, এবং একটি গভীর, ভীতিকর হাসি কক্ষটি ভরিয়ে দিল, তাদের শিরদাঁড়া শীতল করে। অরবটি তীব্রভাবে ঝলমল করতে লাগল, তার আলো অন্ধকার, সন্ত্রস্ত মেঘে পরিণত হলো। আলিয়া মাইলোকে থামানোর জন্য চিৎকার করলেন, কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে।

অরবের ঘূর্ণমান বৃত্তটি তাকে টেনে নিচে নিয়ে গেল, এক অদ্ভুত শক্তি দিয়ে। “মাইলো!” লায়লা চিৎকার করল, কিন্তু যেন পৃথিবী থেমে গিয়েছিল, সে মুহূর্তে সময় যেন স্থির হয়ে গেছে।

এবং তারপর, যেমন শুরু হয়েছিল তেমনই, সবকিছু নীরব হয়ে গেল। ঘূর্ণায়মান বৃত্ত исчез হয়ে গেল, অরবটি ভেঙে গেল, এবং মাইলো হাওয়া হয়ে গেল।

আলিয়া হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, তার শ্বাস আটকে গেল। “না… না, এটা হতে পারে না…”

তরীক, অবিশ্বাসের মুখে, তাকে ধরে বলল, “আমরা এখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত, আলিয়া। এই শহর যা কিছুই না, এটা একটি ফাঁদ।”

কিন্তু আলিয়া নড়লেন না। তার চোখ মাইলো হারিয়ে যাওয়ার স্থান থেকে সরানো যাচ্ছিল না। “আমি তাকে ছেড়ে যাব না। আমাদের তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে।”

লায়লা এগিয়ে এসে, তার কণ্ঠে শান্ত এবং দৃঢ় আত্মবিশ্বাস ছিল। “আলিয়া, আমরা তাকে বাঁচাতে পারব না যদি এখানেই থাকি। শহর আমাদের ভয় ও সন্দেহের সঙ্গে খেলা করছে। আমাদের বেরিয়ে যেতে হবে, বা আমরা সবাই হারিয়ে যাব।”

কিন্তু আলিয়া মাথা নেড়ে বললেন, “আমি তাকে ছেড়ে যেতে পারি না।”

গ্রুপটি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, এক কঠিন সিদ্ধান্তের সামনে দাঁড়িয়ে। আলিয়ার চোখে অশ্রু ছিল। “আমি তাকে ফিরে পাবো… আমি তাকে হারাতে দেব না।”

হঠাৎ, কক্ষের শেষ প্রান্ত থেকে আবার একটি কণ্ঠ শোনা গেল, কিন্তু এবার, এটি অরব থেকে নয়, এক বৃদ্ধের কণ্ঠ ছিল, কেঁদে ওঠা এবং শোকময়।

“তোমরা তাকে বাঁচাতে পারবে না,” কণ্ঠটি বলল। “শহর তার ঋণ আদায় করে নেয়। যারা এখানে প্রবেশ করে, তাদেরকে ঋণ পরিশোধ করতে হয়। সে এখন আমাদের এক হয়ে গেছে, অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। কিন্তু তোমরা… তোমরা এখন সিদ্ধান্ত নিতে পারো। চলে যাবে, নাকি এখানে থাকবে এবং অন্ধকারে হারিয়ে যাবে?”

গ্রুপটি ফিরে তাকাল, আর কক্ষে একটি অন্ধকার স্থানে একটি figura দাঁড়িয়ে ছিল। একজন বৃদ্ধ, যার মুখ একটি হুড দিয়ে ঢাকা ছিল, তার চোখগুলো অন্ধকারে স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলছিল।

“তুমি কে?” আলিয়া তার শোক ও ক্রোধে ভরা কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন।

বৃদ্ধ হাসলেন, তার কণ্ঠে এক পুরনো শোক ছিল। “আমি হারানো আত্মাদের শহরের রক্ষক। আমি শহরের ঋণ নিশ্চিত করি।”

“ঋণ?” তরীক জিজ্ঞাসা করল, তার কণ্ঠে তীক্ষ্ণতা ছিল। “তুমি কী বলতে চাও?”

“শহর তাদের আত্মাকে দাবী করে, যারা এখানে প্রবেশ করতে আসে,” বৃদ্ধটি ব্যাখ্যা করলেন। “তারা শুধু যাত্রী নয়; তারা শহরের ঋণের অংশ, যারা শহরের শান্তিকে বিঘ্নিত করতে সাহস পায়। মাইলো আমাদের এক হয়ে গেছে। এখন তোমরা সিদ্ধান্ত নাও। চলে যাবে, নাকি এখানেই থেকে যাবে এবং হারিয়ে যাবে?”

গ্রুপটি এক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, কঠিন সিদ্ধান্তের সামনে। আলিয়ার চোখে অশ্রু ছিল। “আমি তাকে ছেড়ে যাব না।”

বৃদ্ধটির চোখে এক বিরক্তির হাসি ফুটল। “তুমি চেষ্টা করতে পারো, কিন্তু সাবধান হও – অন্ধকার থেকে ফিরতে আর কোনো উপায় নেই। শহর তার ঋণ পরিশোধ ছাড়াই কিছু দেয় না।”

আলিয়া এগিয়ে গিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, “আমি একটি উপায় বের করবো। আমি তাকে ফিরিয়ে আনব, যেকোনো মূল্যেই।”

তার সাথে সাথে, তাদের পায়ের তলায় জমি আবার দুলে উঠতে শুরু করল, আর শহরের অন্ধকার যেন চারপাশ থেকে তাদের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করল।

গল্পের শিক্ষা:

ক্ষতি এবং দুঃখের সময়, ভয় ও সন্দেহের কাছে আত্মসমর্পণ করা সহজ। কিন্তু আসল শক্তি সেই মুহূর্তে আসে যখন আমরা সেই পরীক্ষাগুলোকে মুখোমুখি করে, তাদের উপরে বিজয়ী হতে পারি। কখনও কখনও, সবচেয়ে বড় যুদ্ধগুলি আমাদের চারপাশের বাহ্যিক শক্তির বিরুদ্ধে নয়, বরং নিজেদের মধ্যেই চলে, যখন আমরা সেই সব জিনিসকে ধরে রাখার জন্য লড়াই করি যা আমরা সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।

ভ্রমণকারী কাফেলার গল্প, পর্ব ৭: ফিসফিস করা ছায়া
ভ্রমণকারী কাফেলার গল্প, পর্ব ৫: ভুলে যাওয়া স্বপ্নের মরুভূমি

Reactions

0
0
0
0
0
0
ইতিমধ্যে এই পোস্টের জন্য প্রতিক্রিয়া করা হয়েছে।

Nobody liked ?

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

GIF