গল্প

ভ্রমণকারী কাফেলার গল্প, পর্ব ৭: ফিসফিস করা ছায়া

0

পর্ব ৭: ফিসফিস করা ছায়া

তাদের পায়ের নিচে ভূমিকম্প থেমে যাওয়ার পরে, কাফেলা হারানো আত্মার শহর-এর গভীরে স্থির দাঁড়িয়ে রইল। এই রহস্যময় অন্ধকার যেন জীবন্ত, শিকারীর মতো চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। আলিয়ার দৃঢ় মনোভাব আগের মতোই জ্বলছিল, কিন্তু বাকিরা দ্বিধান্বিত। তাদের মধ্যে ভয় ধীরে ধীরে বাড়ছিল, কিন্তু আলিয়াকে ছেড়ে যাওয়ার সাহসও ছিল না।

শহরের রক্ষক, সেই বৃদ্ধ লোকটি, ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। “তোমাদের সাহস আছে, কিন্তু শুধুমাত্র সাহস দিয়ে কিছু হবে না। যত গভীরে যাবে, তত বড় ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।”

আলিয়া দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “তুমি বোঝ না। যা কিছু করতে হয় করব। মাইলোকে এখানে রেখে যাব না।”

রক্ষক মাথা কাত করল, তার চোখে বিদ্রূপের ছাপ। “যা ইচ্ছে করো। কিন্তু সাবধান থেকো—এই শহর ক্ষমা করে না। যারা এর গভীরে প্রবেশ করে, তারা ফিরে আসতে পারে না।”

তারপর, কোনো শব্দ না করে, রক্ষক অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

“আলিয়া,” তারিক বলল, তার কণ্ঠে শঙ্কার সুর। “তুমি কি নিশ্চিত? এই জায়গাটা… এটা স্বাভাবিক নয়। আমরা মাইলোকে ইতোমধ্যে হারিয়েছি। যদি তোমাকেও হারাই—”

“তাহলে আমরা সবকিছু হারাব,” আলিয়া বাধা দিয়ে বলল। তার কণ্ঠ দৃঢ়, কিন্তু তার চোখে ভয়ের ছায়া ছিল। “মাইলো আমাদের দলের একজন। যদি তোমাদের কেউ এই অবস্থায় থাকত, আমি এক মুহূর্তের জন্যও দ্বিধা করতাম না। আমাকে ওকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বলো না।”

তারিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়ল। লায়লা আর অন্যরা অস্থির দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকাল, তারপর আলিয়ার পেছনে এগিয়ে চলল।

ছায়ার পথ

যতই তারা সামনে এগোতে থাকল, ততই বাতাস ঠাণ্ডা হতে লাগল। একসময় ধ্বংসপ্রাপ্ত রাস্তা এখন যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছিল, একটি ভ্রান্তিকর গোলকধাঁধার মতো। ফিসফিসানিগুলো শুরুতে ছিল মৃদু, যেন দূর থেকে আসা কোনো আওয়াজ। কিন্তু ধীরে ধীরে তা জোরালো হতে থাকল। প্রতিটি কণ্ঠ আলাদা, নাম ডাকা, গোপন কথা বলা, আর ভয় জাগানো।

লায়লা হঠাৎ থেমে গেল, তার মুখ সাদা হয়ে গিয়েছিল। “আমি… আমি আমার মায়ের কণ্ঠ শুনছি। তিনি আমায় ডাকছেন।”

তারিক তার হাতে ধরল। “এগুলো বাস্তব নয়, লায়লা। কিছুই বাস্তব নয়। এগুলো শোনা বন্ধ করো।”

কিন্তু ফিসফিসানিগুলো যেন তাদের মনকে আচ্ছন্ন করছিল। প্রত্যেকে কিছু না কিছু শুনতে পেল—কেউ হারানো প্রিয়জনের কণ্ঠ, কেউ ভুলের স্মৃতি, আবার কেউ গভীর পাপের দগদগে চিহ্ন। এমনকি আলিয়াও থমকে গেল, যখন একটি পরিচিত কণ্ঠ অন্ধকারের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হলো।

“আলিয়া… আমার মেয়ে…”

তার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে গেল। এই কণ্ঠটি সে বহু বছর শুনেনি—তার মায়ের মৃত্যু থেকে আর কখনোই না। সে ঘুরে তাকাল, আর সেখানে তাকে দেখতে পেল। তার মা, ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে, তার মুখে এক অপার্থিব আলো।

“মা?” আলিয়া ফিসফিস করে বলল, তার চোখে অশ্রু জমে উঠছিল।

“আলিয়া, আমার সন্তান,” সেই আকৃতি কোমল কণ্ঠে বলল। “তোমাকে এই পথ ত্যাগ করতে হবে। আমার সাথে চলো, আমরা আবার একসাথে থাকব।”

তারিক তাকে শক্ত করে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “আলিয়া, নিজেকে সামলো! ওটা তোমার মা নয়—এটা শহরের ছলচাতুরি!”

কিন্তু আলিয়া কাঁপতে কাঁপতে এক পা এগিয়ে গেল, তার মন হারিয়ে গেল পুরনো ভালোবাসার স্মৃতিতে।

ঠিক তখনই, একটি বিকট চিৎকার সবকিছু থামিয়ে দিল। এটা ছিল লায়লার চিৎকার। সে হোঁচট খেয়ে পড়েছিল এক অন্ধকার গহ্বরের পাশে, যা হঠাৎ করেই যেন মাটিতে খুলে গিয়েছিল। এই চিৎকারে আলিয়া বাস্তবে ফিরে এল, আর তার মায়ের অবয়ব ধোঁয়ায় মিলিয়ে গেল।

বিস্মৃত বেদি

ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটার পর, দলটি শহরের কেন্দ্রে পৌঁছাল। একটি বিশাল, ভাঙাচোরা মন্দির দাঁড়িয়ে ছিল। মন্দির থেকে একটি অদ্ভুত লাল আলো ঠিকরে বের হচ্ছিল। তার কেন্দ্রে একটি বেদি ছিল, কালো পাথরের তৈরি, যার চারপাশে দাঁড়িয়েছিল অস্পষ্ট আত্মার মতো অবয়ব। আর বেদির ওপরে, নিথর শুয়ে ছিল মাইলো।

“মাইলো!” চিৎকার করে দৌড়ে গেল আলিয়া।

কিন্তু যতই সে এগিয়ে গেল, সেই ছায়ামূর্তিগুলো ধীরে ধীরে তার দিকে ফিরল। তাদের ফাঁকা চোখে অদ্ভুত জ্যোতি ফুটছিল। তাদের কণ্ঠ একসঙ্গে প্রতিধ্বনিত হলো। “একটি আত্মা দাবি করা হয়েছে। ঋণ পরিশোধ করতে হবে।”

“তোমরা কী বলতে চাও?” আলিয়া চিৎকার করল। “আমাকে নিয়ে যাও। ওকে ছেড়ে দাও!”

ছায়াগুলো হিসহিস করতে লাগল। “শহর কোনো চুক্তি করে না। শুধুমাত্র ইচ্ছুকরা প্রবেশ করে, এবং ইচ্ছুকরাই এখান থেকে যায়। যদি ওকে ফিরিয়ে নিতে চাও, তবে এর চেয়েও বড় কিছু উৎসর্গ করতে হবে।”

“কী চাও তোমরা?” তারিক জিজ্ঞেস করল।

ছায়াগুলো বেদির দিকে ইশারা করল। “বিশ্বাসের বন্ধন। যা তোমাদের একত্রে বেঁধে রেখেছে। যদি সেটি ছিঁড়ে দাও, ও মুক্ত হবে, কিন্তু তোমরা আর কখনো আগের মতো এক হতে পারবে না।”

ঐক্যের শক্তি

আলিয়ার চোখ ছলছল করছিল। “আমরা একটি পরিবার। বিশ্বাস ছাড়া আমরা কিছুই না।”

লায়লা তার পাশে দাঁড়াল। “আলিয়া, আমরা এতোদূর এসেছি। আমরা মাইলোকে হারাতে পারি না। কিন্তু নিজেদেরও হারাতে পারি না।”

তারিক একটু থেমে বলল, “হয়তো আমরা একসঙ্গে দাঁড়ালে, শহর আমাদের ভাঙতে পারবে না।”

আলিয়া তার বন্ধুদের দিকে তাকাল। তারপর দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আমরা এক। যদি তোমরা ওকে নিতে চাও, আমাদের সবাইকে নিতে হবে।”

তারা একসঙ্গে বেদির চারপাশে দাঁড়িয়ে হাত ধরল।

ছায়াগুলো হাউমাউ করে চিৎকার করতে লাগল, যেন তাদের অস্তিত্ব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। লাল আলো চোখ ধাঁধানো হয়ে উঠল। তারপর, সবকিছু থেমে গেল।

তারা চোখ খুলল। বেদি শূন্য। আর সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল মাইলো, অপ্রস্তুত, কিন্তু জীবিত।

“আলিয়া?” সে ফিসফিস করল।

আলিয়া তাকে জড়িয়ে ধরল। “আমরা তোমার সাথে আছি, মাইলো। আমরা সবাই আছি।”

শহরের ছায়াগুলো ভেঙে পড়তে লাগল, আর ধ্বংসস্তূপে সূর্যের আলো এসে পড়ল। তারা ধীরে ধীরে শহর থেকে বেরিয়ে এল, আর পেছনে ফেলে গেল এই অভিশপ্ত স্থানটিকে, যা আর কখনো জীবন্ত হবে না।

গল্পের শিক্ষা:

ঐক্য এবং বিশ্বাসের শক্তি এমনকি সবচেয়ে অন্ধকার ছায়াকেও জয় করতে পারে। পরিবার কেবল রক্তের সম্পর্ক নয়, বরং একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি।

ভ্রমণকারী কাফেলার গল্প, পর্ব ৬: হারানো আত্মাদের শহর

Reactions

0
0
0
0
0
0
ইতিমধ্যে এই পোস্টের জন্য প্রতিক্রিয়া করা হয়েছে।

Nobody liked ?

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

GIF