তালনবমী
ঝমঝম বর্ষা।
ভাদ্র মাসের দিন। আজ দিন পনেরো ধরে বর্ষা নেমেছে, তার আর বিরামও নেই, বিশ্রামও নেই। ক্ষুদিরাম ভটচাজের বাড়িতে আজ দু-দিন হাঁড়ি চড়েনি।
ক্ষুদিরাম সামান্য আয়ের গৃহস্থ। জমিজমার সামান্য কিছু আয় এবং দু-চার ঘর শিষ্য-যজমানের বাড়ি ঘুরে ঘুরে কায়ক্লেশে সংসার চলে। এই ভীষণ বর্ষায় গ্রামের কত গৃহস্থের বাড়িতেই পুত্র-কন্যা অনাহারে আছে—ক্ষুদিরাম তো সামান্য গৃহস্থ মাত্র! যজমান-বাড়ি থেকে যে কটি ধান এসেছিল, তা ফুরিয়ে গিয়েচে।—ভাদ্রের শেষে আউশ ধান চাষিদের ঘরে উঠলে তবে আবার কিছু ধান ঘরে আসবে, ছেলেপুলেরা দু-বেলা পেটপুরে খেতে পাবে।
নেপাল ও গোপাল ক্ষুদিরামের দুই ছেলে। নেপালের বয়স বছর বারো, গোপালের দশ। ক-দিন থেকে পেটভরে না-খেতে পেয়ে ওরা দুই ভায়েই সংসারের ওপর বিরক্ত হয়ে উঠেছে।
নেপাল বললে, “এই গোপলা, ক্ষিদে পেয়েচে না তোর?”
গোপাল ছিপ চাঁচতে চাঁচতে বলল, “হু, দাদা।”
“মাকে গিয়ে বল; আমারও পেট চুই চুই করচে।”
“মা বকে; তুমি যাও দাদা।”
“বকুক গে। আমার নাম করে মাকে বলতে পারবিনে?”
এমন সময় পাড়ার শিবু বাঁড়ুজ্যের ছেলে চুনিকে আসতে দেখে নেপাল ডাকলে, “ও চুনি, শুনে যা!”
চুনি বয়সে নেপালের চেয়ে বড়ো। অবস্থাপন্ন গৃহস্থের ছেলে, বেশ চেহারা। নেপালের ডাকে সে ওদের উঠোনের বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে বললে, “কি?”
“আয় না ভেতরে।” “না যাব না, বেলা যাচ্ছে। আমি জটি পিসিমাদের বাড়ি যাচ্ছি। মা সেখানে
রয়েছে কিনা, ডাকতে যাচ্ছি।”
“কেন, তোর মা এখন সেখানে যে?”
“ওদের ডাল ভাঙতে গিয়েছে। তালনবমীর বের্তো আসচে এই মঙ্গলবার; ওদের বাড়ি লোকজন খাবে।”
“সত্যি?”
“তা জানিসনে বুঝি? আমাদের বাড়ির সবাইকে নেমন্তন্ন করবে, গাঁয়েও বলবে।”
“আমাদেরও করবে?’
“সবাইকে যখন নেমন্তন্ন করবে, তোদের কি বাদ দেবে?”
চুনি চলে গেলে নেপাল ছোটো ভাইকে বললে, “আজ কী বার রে? তা তুই কী জানিস? আজ শুক্রবার বোধ হয়—মঙ্গলবারে নেমন্তন্ন।”
গোপাল বললে, “কী মজা, না দাদা”?
“চুপ করে থাক,—তোর বুদ্ধিশুদ্ধি নেইঃ; তালনবমীর বের্তোয় তালের বড়া করে, তুই জানিস?”
গোপাল সেটা জানত না। কিন্তু দাদার মুখে শুনে খুব খুশি হয়ে উঠল। সত্যিই তা যদি হয়, তবে সে সুখাদ্য খাবার সম্ভাবনা বহুদূরবর্তী নয়, ঘনিয়ে এসেছে কাছে। আজ কী বার সে জানে না, সামনের মঙ্গলবারে—নিশ্চয় তার আর বেশি দেরি নেই।
দাদার সঙ্গে বাড়ি যাবার পথে পড়ে জটি পিসিমার বাড়ি। নেপাল বললে, ‘‘তুই দাঁড়া, ওদের বাড়ি ঢুকে দেখে আসি। ওদের বাড়ি তালের দরকার হবে, যদি তাল কেনে!”
এ গ্রামের মধ্যে তালের গাছ নেই। মাঠে প্রকাণ্ড তালদিঘি, নেপাল সেখান থেকে তাল কুড়িয়ে এনে গাঁয়ে বিক্রি করে।
জটি পিসিমা সামনেই দাঁড়িয়ে। তিনি গ্রামের নটবর মুখুজ্যের স্ত্রী, ভালো নাম হরিমতী; গ্রামসুদ্ধ ছেলে-মেয়ে তাঁকে ডাকে জটি পিসিমা।
পিসিমা বললেন, “কীরে?”
“তাল নেবে পিসিমা?”
“হ্যাঁ, নেব বই কী। আমাদের তো দরকার হবে মঙ্গলবার।”
ঠিক এই সময় দাদার পিছু পিছু গোপালও এসে দাঁড়িয়েছে। জটি পিসিমা বললেন, “পেছনে কে রে? গোপাল? তা সন্ধেবেলা দুই ভায়ে গিয়েছিলি কোথায়?”
নেপাল সলজ্জমুখে বললে, “মাছ ধরতে।”
“পেলি?”
“ওই দুটো পুঁটি আর একটা ছোটো বেলে…তাহলে যাই পিসিমা?”
“আচ্ছা এসোগে বাবা, সন্ধে হয়ে গেল; অন্ধকারে চলাফেরা করা ভালো নয় বর্ষাকালে।”
জটি পিসিমা তাল সম্বন্ধে আর কোনো আগ্রহ দেখালেন না বা তালনবমীর ব্রত উপলক্ষ্যে তাদের নিমন্ত্রণ করার উল্লেখও করলেন না,—যদিও দুজনেরই আশা ছিল হয়তো জটি পিসিমা তাদের দেখলেই নিমন্ত্রণ করবেন এখন। দরজার কাছে গিয়ে নেপাল আবার পেছন ফিরে জিগ্যেস করলে, “তাল নেবেন তাহলে?”
“তাল? তা দিয়ে যেয়ো বাবা। ক-টা করে পয়সায়?” “দুটো করে দিচ্ছি পিসিমা। তা নেবেন আপনি, তিনটে করেই নেবেন।”
“বেশ কালো হেঁড়ে তাল তো? আমাদের তালের পিঠে হবে তালনবমীর দিন–ভালো তাল চাই।”
“মিশকালো তাল পাবেন। দেখে নেবেন আপনি।”
গোপাল বাইরে এসেই দাদাকে বললে, “কবে তাল দিবি দাদা?”
“কাল।”
“তুই ওদের কাছে পয়সা নিসনে দাদা।”
নেপাল আশ্চর্য হয়ে বললে, “কেন রে?”
“তাহলে আমাদের নেমন্তন্ন করবে, দেখিস এখন।”
“দূর, তা হয় না! আমি কষ্ট করে তাল কুড়ব—আর পয়সা নেব না?”
রাত্রে বৃষ্টি নামে। হু হু বাদলার হাওয়া সেই সঙ্গে। পুবদিকের জানলার কপাট দড়িবাঁধা; হাওয়ায় দড়ি ছিড়ে সারারাত খট খট শব্দ করে ঝড়বৃষ্টির দিনে। গোপালের ঘুম হয় না, তার যেন ভয়ভয় করে। সে শুয়ে শুয়ে ভাবচে—দাদা তাল যদি বিক্রি করে, তবে ওরা আর নেমন্তন্ন করবে না! তা কখনো করে?
খুব ভোরবেলা উঠে গোপাল দেখলে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে। কেউই তখনো ওঠেনি। রাত্রের বৃষ্টি থেমে গিয়েচে,সামান্য একটু টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। গোপাল একছুটে চলে গেল গ্রামের পাশে সেই তালদিঘির ধারে। মাঠে একহাঁটু জল আর কাদা। গ্রামের উত্তরপাড়ার গণেশ কাওরা লাঙল ঘাড়ে এই এত সকালে মাঠে যাচ্ছে। ওকে দেখে বললে, “কি খোকা ঠাকুর, যাচ্ছ কনে এত ভোরে?”
“তাল কুড়তে দিঘির পাড়ে।”
“বড্ড সাপের ভয় খোকাঠাকুর। বর্ষাকালে ওখানে যেয়ো না একা-একা।”
গোপাল ভয়ে ভয়ে দিঘির তালপুকুরের তালের বনে ঢুকে তাল খুঁজতে লাগল। বড়ো আর কালো কুচকুচে একটা মাত্র তাল প্রায় জলের ধারে পড়ে; সেটা কুড়িয়ে নিয়ে ফিরে আসবার পথে আরও গোটা-তিনেক ছোটো তাল পাওয়া গেল। ছেলেমানুষ, এত তাল বয়ে আনার সাধ্য নেই, দুটি মাত্র তাল নিয়ে সোজা একেবারে জটি পিসিমার বাড়ি হাজির।
জটি পিসিমা সবেমাত্র সদর দোর খুলে দোরগোড়ায় জলের ধারা দিচ্ছেন, ওকে এত সকালে দেখে অবাক হয়ে বললেন, “কীরে খোকা?”
গোপাল একগাল হেসে বললে, “তোমার জন্যে তাল এনিচি পিসিমা।”
জটি পিসিমা আর কিছু না-বলে তাল দুটো হাতে করে নিয়ে বাড়ির ভেতর চলে গেলেন।
গোপাল একবার ভাবলে, তালনবমী কবে জিগ্যেস করে; কিন্তু সাহসে কুলোয় না তার। সারাদিন গোপালের মন খেলাধুলোর ফাঁকে কেবলই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। ঘন বর্ষার দুপুরে, মুখ উঁচু করে দেখেনারকোল গাছের মাথা থেকে পাতা বেয়ে জল ঝরে পড়চে, বাঁশঝাড় নুয়ে নুয়ে পড়ছে বাদলার হাওয়ায়, বকুলতলার ডোবায় কটকটে ব্যাঙের দল থেকে থেকে ডাকছে।
গোপাল জিগ্যেস করলে, “ব্যাংগুলো আজকাল তেমন ডাকে না কেন মা?”
গোপালের মা বলেন, ‘নতুন জলে ডাকে, এখন পুরোনো জলে তত আমোদ নেই ওদের।”
“আজ কী বার, মা?”
“সোমবার। কেন রে? বারের খোঁজে তোর কী দরকার?”
“মঙ্গলবারে তালনবমী, না মা?”
“তা হয়তো হবে। কি জানি বাপু! নিজের হাঁড়িতে চাল জোটে না, তালনবমীর খোঁজে কী দরকার আমার?”
সারাদিন কেটে গেল। নেপাল বিকেলের দিকে জিগ্যেস করলে, “জটি পিসিমার বাড়িতে তাল দিইছিলি আজ সকালে?” কোথায় পেলি তুই? আমি তাল দিতে গেলে পিসি বললেন, “গোপাল তাল দিয়ে গেছে, পয়সা নেয়নি”—“কেন দিতে গেলি তুই? একটা পয়সা হলে দুজনে মুড়ি কিনে খেতাম!”
“ওরা নেমন্তন্ন করবে, দেখিস দাদা, কাল তো তালনবমী!”
“সে এমনিই নেমন্তন্ন করবে, পয়সা নিলেও করবে। তুই একটা বোকা!”
“আচ্ছা দাদা, কাল তো মঙ্গলবার না?”
“হুঁ।”
রাত্রে উত্তেজনায় গোপালের ঘুম হয় না। বাড়ির পাশের বড়ো বকুলগাছটায় জোনাকির ঝাঁক জ্বলচে; জানলা দিয়ে সেদিকে চেয়ে চেয়ে সে ভাবে—কাল সকালটা হলে হয়। কতক্ষণে যে রাত পোহাবে!…
জটি পিসিমা আদর করে ওকে বললেন খাওয়ানোর সময়, “খোকা, কাঁকুড়ের ডালনা আর নিবি? মুগের ডাল বেশি করে মেখেনে।” জটি পিসিমার বড়ো মেয়ে লাবণ্যদি একখানা থালায় গরম গরম তিল-পিটুলি ভাজা এনে ওর সামনে ধরে হেসে বললে, “খোকা, ক-খানা নিবি তিল-পিটুলি?”—বলেই লাবণ্যদি থালাখানা উপুড় করে তার পাতে ঢেলে দিলে। তার পর জটি পিসিমা আনলেন পায়েস আর তালের বড়া। হেসে বললেন “খোকা যাই তাল কুড়িয়ে দিয়েছিলি, তাই পায়েস হল!…খা, খা,আজ যে তালনবমী রে!”…কত কী চমৎকার ধরনের রাঁধা তরকারির গন্ধ বাতাসে! খেজুরগুড়ের পায়েসের সুগন্ধ বাতাসে! গোপালের মন খুশি ও আনন্দে ভরে উঠল। সে বসে বসে খাচ্ছে, কেবলই খাচ্ছে।…সবারই খাওয়া শেষ, ও তবুও খেয়েই যাচ্ছে…লাবণ্যদি হেসে হেসে বলছে, “আর নিবি তিল-পিটুলি?”…
“ও গোপাল?”
হঠাৎ গোপাল চোখ চেয়ে দেখলে—জানালার পাশে বর্ষার জলে ভেজা ঝোপঝাড়, তাদের সেই আতাগাছটা…সে শুয়ে আছে তাদের বাড়িতে। মার হাতের মৃদু ঠেলায় ঘুম ভেঙেছে, মা পাশে দাঁড়িয়ে বলছেন, “ওঠ ওঠ, বেলা হয়েচে কত! মেঘ করে আছে তাই বোঝা যাচ্ছে না!”
বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে সে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে রইল।
“আজ কী বার, মা…?”
“মঙ্গলবার।”
তাও তো বটে! আজই তো তালনবমী! ঘুমের মধ্যে ওসব কি হিজিবিজি স্বপ্ন সে দেখছিল?
বেলা আরও বাড়ল, ঘন মেঘাচ্ছন্ন বর্ষার দিনে যদিও বোঝা গেল না বেলা কতটা হয়েছে। গোপাল দরজার সামনে একটা কাঠের গুঁড়ির ওপর ঠায় বসে রইল। বৃষ্টি নেই একটুও, মেঘ-জমকালো আকাশ। বাদলের সজল হাওয়ায় গা শিরশির করে। গোপাল আশায় আশায় বসে রইল বটে, কিন্তু কই, পিসিমাদের বাড়ি থেকে কেউ তো নেমন্তন্ন করতে এল না!
অনেক বেলায় তাদের পাড়ার জগবন্ধু চক্কোত্তি তাঁর ছেলে-মেয়ে নিয়ে সামনের পথ দিয়ে কোথায় যেন চলেছেন। তাদের পেছনে রাখাল রায় ও তাঁর ছেলে সানু; তার পেছনে কালীবর বাড় জ্যের বড়ো ছেলে পাঁচু আর ও-পাড়ার হরেন…
গোপাল ভাবলে, এরা যায় কোথায়?
এ-দলটি চলে যাবার কিছু পরে বুড়ো নবীন ভটচাজ ও তার ছোটো ভাই দীনু, সঙ্গে একপাল ছেলে-মেয়ে নিয়ে চলেছে।
দীনু ভটচাজের ছেলে কুড়োরাম ওকে দেখে বললে, “এখানে বসে কেনরে? যাবিনে?”
গোপাল বললে, “কোথায় যাচ্ছিস তোরা?”
“জটি পিসিমাদের বাড়ি তালনবমীর নেমন্তন্ন খেতে। করেনি তোদের? ওরা বেছে বেছে বলেছে কিনা, সবাইকে তো বলেনি…”
গোপাল হঠাৎ রাগে, অভিমানে যেন দিশেহারা হয়ে গেল। রেগে দাঁড়িয়ে উঠে বললে, “কেন করবে না আমাদের নেমন্তন্ন? আমরা এর পরে যাব…”
রাগ করবার মতো কী কথা সে বলেচে বুঝতে না-পেরে কুড়োরাম অবাক হয়ে বললে, “বা রে! তা অত রাগ করিস কেন? কী হয়েছে?”
ওরা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে গোপালের চোখে জল এসে পড়ল—বোধ হয় সংসারের অবিচার দেখেই। পথ চেয়ে সে বসে আছে ক-দিন থেকে। কিন্তু তার কেবল পথ চাওয়াই সার হল! তার সজল ঝাপসা দৃষ্টির সামনে পাড়ার হারু,
হিতেন, দেবেন, গুটকে তাদের বাপ-কাকাদের সঙ্গে একে একে তার বাড়ির সামনে দিয়ে জটি পিসিমাদের বাড়ির দিকে চলে গেল…
গল্প: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়